আধুনিক মানুষের আদি নিবাস কোথায়?
আফ্রিকাই আধুনিক মানুষের আদি বাস্তুভিটা, এখন পর্যন্ত নানা প্রমাণ সাপেক্ষে এমনটাই জানি আমরা। তবে ভবিষ্যতে আরও আবিষ্কারের কারণে বদলে যেতে পারে এ ধারণাও।
বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই মনে করেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার আগে প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে বিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে আধুনিক মানুষের যাত্রা শুরু হয়। হোমো সাপিয়েন্স নিয়ান্ডারথালস মানুষের সমসাময়িক প্রজাতি হলেও ধারণা করা হয় আমাদের পূর্বুপুরুষের প্রজাতি আরও ৫ লাখ বছর আগেই নিয়ান্ডারথাল প্রজাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
২০০৩ সালে পূর্ব ইথিওপিয়ার একটি গ্রামে ১ লাখ ৬০ হাজার বছর পুরনো মানুষের মাথার খুলি খুঁজে পাওয়া যায়। এটির শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য ছিল কিছুটা আলাদা। প্রশস্ত কপাল, বড় মস্তিষ্কের এই মাথার খুলিই ছিল তখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে পুরনো আধুনিক মানুষের প্রমাণ। এর ঠিক ২ বছর পরই এই ইথিওপিয়ার ওমো-কিবিশে মেলে আরও ৩৫ হাজার বছর পুরনো আধুনিক মানুষের খুলি। সব মিলিয়ে পূর্ব আফ্রিকাই আধুনিক মানুষের আদি নিবাস হওয়ার সম্ভাবনাই প্রকট হয়ে ওঠে।
পূর্ব আফ্রিকাতেই আধুনিক মানুষের যাত্রা শুরু হয়- প্রত্নতাত্ত্বিক, জিনতত্ত্ববিদ ও জীবাশ্ম বিজ্ঞানীদের এ বিশ্বাস আরও প্রবল হয়ে ওঠে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও বিভিন্ন আবিষ্কারের ফলে বদলে যেতে পারে এ ধারণাও।
নতুন আবিষ্কার
২০১৭ সালে জীবাশ্মবিজ্ঞানী জিন-জ্যাকস হাবলিন মানুষের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো একটি আবিষ্কার করেন। ১৯৮০'র দশক থেকেই হাবলিন উত্তর আফ্রিকার মরক্কোতে পাহাড়ি অঞ্চলের গুহায় খুঁজে পাওয়া জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এই জীবাশ্মের সাথে নিয়ান্ডারথালের চেয়ে আধুনিক মানুষের সাথেই বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য দেখে ধারণা করা হয় তারা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার- ২ লাখ বছর আগে ওই অঞ্চলের অধিবাসী ছিল। তবে এই সময়কালই পূর্ববর্তী আবিষ্কারের প্যাটার্নের সাথে মেলেনি।
ওমো-কিবোশের পূর্ববর্তী আবিষ্কার, যেখানে আধুনিক মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল ধারণা করা হয়; এ আবিষ্কারের সাথেই এ নতুন এ ব্যাপারটি সাংঘর্ষিক। কেননা একই সময়কালে আরেকজন মানুষের মহাদেশের একদম অন্যপাশে গিয়ে বাস করার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ২০১৭ সালে মরক্কোতে হাবলিনের আবিষ্কৃত ফসিলের বয়স অন্তত ৩ লাখ বছর পুরনো হওয়ার প্রমাণ মেলে; এতে তিনি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যান।
'আমি অনেক পুরনো কিছু খুঁজে পেয়েছি ভাবছিলাম, কিন্তু এতো পুরনো তা ভাবতেও পারিনি। আধুনিক মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের সময়কাল আমূলে পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এর মাধ্যমে।'
বিতর্কিত ইতিহাস
৬০ লক্ষ বছর আগে গ্রেট এপ বা মূল প্রজাতির জনপুঞ্জ থেকে আলাদা হয়ে মানুষের বিবর্তন হয়। ৪০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে আধুনিক মানুষ। তবে আধুনিক মানুষের আদি নিবাস এখনো বিতর্কিত।
মানুষের প্রকৃত আদি নিবাসের ধারনা আমাদের বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রাণী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। কিভাবে হোমো (Homo) গণের একমাত্র প্রজাতি হিসেবে এখনো টিকে আছি আমরা এব্যাপারে আরও স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যাবে।
২০১৯ সালে জিনতত্ত্ববিদ ভ্যানেসা হায়েসের নেতৃত্বে ইউনিভার্সিটি অব সিডনির গারভান ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল রিসার্চের এক দল গবেষক এই প্রশ্নের উত্তর দেন। তারা বিশ্বের তৎকালীন জলবায়ু ও মডার্ন মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র (এমটিডিএনএ) ভাষাগত ও কম্পিউটার সিমুলেশনের গবেষণা করেন। তারা বিভিন্ন গোষ্ঠীর ২০০ জন মানুষের ডিএনএ পরীক্ষা করে ১০০০ আফ্রিকানের এমটিডিএন'র তথ্যের তুলনা করেন।
সবচেয়ে পুরনো এমটিডিএনএ'র অধিকারীরা খৈসান ভাষাভাষী, মূলত নামিবিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার শিকারীরা এ ভাষা ব্যবহার করেন। শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার জীবিত মানুষের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য থাকায় গবেষণাটিতে বলা হয়, তারা বর্তমানের আধুনিক মানব জাতির পূর্বপুরুষের বংশধর।
উত্তর বতসোয়ানার জামবেজি নদীর দক্ষিণাঞ্চলই আমাদের আদি নিবাস বলে জানানো হয় গবেষণাটিতে। তবে এই গবেষণাও অনেক গবেষকদের সমালোচনার মুখে পড়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার বিবর্তন সংক্রান্ত জিনতত্ত্ববিদ সারাহ টিস্কওফ জানান, 'বর্তমানে মানুষের জনসংখ্যার মধ্যে যে স্থানে সবচেয়ে পুরনো বংশানুক্রম খুঁজে পাওয়া গেছে, সে জায়গাই মানুষের আদি নিবাস দাবি করা হয়েছে এই গবেষণায়। তবে আমরা এখনো জানিনা এই মানুষদের পূর্বপুরুষরা কোথায় ছিল, ৫০ হাজার বছর আগে তারা এখানেই ছিল তার নিশ্চয়তাও নেই।'
টিস্কওফ ও তার সহকর্মীরা মানব ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে মানুষের স্থানান্তরের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরে গবেষণাটির সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেন। বংশানুক্রমের প্রশ্নে এমটিডিএনএ'র ব্যবহারের সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রগুলো নিয়েও প্রশ্ন করেন তারা।
আদি আবাসস্থল কি শুধু একটি?
আধুনিক মানুষের আদি নিবাস শুধু একটি এ ধারণার ব্যাপারেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায়। সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে প্রজননেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে; বিভিন্ন স্থানে বিবর্তনের ক্ষেত্রে একাধিক প্রজাতি সংশ্লিষ্ট ছিল এমনটাই নির্দেশ করছে সাম্প্রতিক এসব আবিষ্কার।
ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর জীবাশ্ম বিজ্ঞানী বেনস ভায়োলা জানান, 'শুধু একটি মাত্র গোষ্ঠী ছিল ব্যাপারটি এমন নয়, বিভিন্ন স্থানে একাধিক গোষ্ঠী ছিল। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে জনবসতি বেশি ছিল। আফ্রিকার পশ্চিমেও হয়তো বসতি ছিল, তবে এ অঞ্চলে আমরা কোনো জীবাশ্ম খুঁজে পানি, জীবাশ্ম টিকে থাকার জন্য এখানকার আবহাওয়া অনুকূল নয়।'
মিশ্র প্রজাতি
নিয়ান্ডারথাল ছাড়া মানুষের আদিম আরেকটি প্রজাতি ডেনিসোভান; আনুমানিক ৪০ হাজার বছর আগে এই প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২০১৮ সালে নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভানের দুটি প্রজাতির প্রজননে জন্ম নেয়া মানুষের জীবাশ্ম বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়। তার নাম দেয়া হয়েছিল ডেনি; প্রায় ৯০ হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াতেন মানুষের দুটি প্রজাতির প্রজননে জন্ম নেয়া এই নারী। বর্তমানে ইউরোপ, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মানুষের জিনেও নিয়ান্ডারথালদের জিনের উপস্থিতি দেখা যায়।
মরক্কোতে হাবলিনের জীবাশ্ম আবিষ্কারের অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া পাথরের যন্ত্র পাওয়া গেছে কেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও। মানুষের তৈরি একই সময়ের যন্ত্র বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যাওয়ার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। বিভিন্ন অঞ্চলে আলাদাভাবে মানুষ এসব আবিষ্কার করে, অথবা এক জায়গায় আবিষ্কৃত হওয়ার পর তা ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় সম্ভাবনাই বেশি বলে জানান হাবলিন।
তথ্যের বিভ্রান্তি
মরক্কো এবং ইথিওপিয়ায় খুঁজে পাওয়া নমুনার সম্পর্কের শক্ত প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। 'প্রমাণের অভাব থাকা মানেই এই নয় যে প্রমাণ নেই।' বলেন হাবলিন।
পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের জলবায়ু ও ভূপ্রাকৃতিক অবস্থা জীবাশ্মের টিকে থাকার জন্য সহায়ক না। ফলে বেশ কিছু জায়গায় জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়ার কাজ কঠিন। একারণেই বিজ্ঞানীদের বিবর্তন সম্বন্ধীয় বিস্তারিত গবেষণা নানা সময় বাধাগ্রস্ত হয়েছে, বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান হাবলিন। আবার একারণেই বিজ্ঞানীদের কয়েকটি স্থানে সীমাবদ্ধ না থেকে, প্রমাণ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকলেও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে অনুসন্ধান চালানো প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
মানব ইতিহাসের বেশ কিছু অংশই এখনো অজানাই রয়ে গেছে, পরবর্তী কোনো আবিষ্কারে আরও বিস্তারিত গবেষণার পথ খুলে যেতে পারে। আধুনিক মানুষ কীভাবে আফ্রিকায় বিবর্তিত হলো এব্যাপারেও আরও পরিষ্কার ধারনা পাওয়া যাবে।