আমার কর্মস্থলে যখন অ্যাডাম স্মিথের অদৃশ্য হাত সরালেন ডারউইন
আমার পুরানো অফিসে একদিন দেখি একটা ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে - অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের ‘অদৃশ্য হাত’ কাজ করতে শুরু করেছে পত্রিকা অফিসটিতেও। অ্যাডাম স্মিথের তত্ত্ব বলছে, বাজারে চাহিদা আর জোগানের ভারসাম্য রাখতে গিয়ে একটা অদৃশ্য হাত কাজ করে। আর এই অদৃশ্য হাতের কেরামতি শুরু হল আমার সংবাদপত্রের অফিসেও। তবে এবার আর বাজার বা পণ্য নয়, শুরু হলো কাজের দক্ষতা নিয়ে।
অফিসে কিছু নির্দিষ্ট লোক ছিল যাদের কাজ ছিল হার্ড কপি থেকে কম্পিউটারে টাইপ করা। তাদেরকে বলা হতো ‘কম্পোজিটর’। সেই দিনগুলোতে, আমাদের কাছে খুব অল্প কয়েকটা কম্পিউটার ছিল এবং বেশিরভাগ ‘স্টোরি’ (পাঠকদের বোঝার জন্য বলছি, এই ‘স্টোরি’ মানে গালগল্প নয়। সাংবাদিকরা যা কিছুই লেখেন সাধারণত তাকে ‘স্টোরি’ই বলা হয়), টাইপ রাইটারে একবার করে লেখা হতো। তাই সেগুলোকে আবার ডিজিটাল সংস্করণে রূপান্তর করা রীতিমতো একটি অপচয়, দুইবার করে করতে গিয়ে ডাবল কাজ করতে হতো।
এরপর একসময় বাজারে কম্পিউটার সস্তা হয়ে উঠল। একে একে সব সাংবাদিক ধীরে ধীরে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করলেন। ফলে 'কমপোজিটার' প্রজাতিটি ক্রমেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছিল।
এরপর কি হবে তা তো পরিষ্কার। এই পরিস্থিতিতে অ্যাডাম স্মিথের ‘অদৃশ্য হাত’ হস্তক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুত- বাজার সেই পথেই এগুবে আর অপ্রয়োজনীয় কর্মীদের ছেঁটে ফেলা হবে- মুক্ত বাজার অর্থনীতি এভাবেই কাজ করে।
কিন্তু অ্যাডাম স্মিথের চেয়েও বড় একজন ‘অর্থনীতিবিদ’ আছেন যিনি এই পরিস্থিতির একটা যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি চার্লস ডারউইন! অবাক কাণ্ড বলে মনে হচ্ছে তো? চলুন ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ডারউইনের ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ বইটিতে তিনি দেখালেন প্রকৃতি আসলে ন্যাচারাল সিলেকশন বা প্রাকৃতিক নির্বাচন মেনে চলে। এখানে যোগ্যরাই টিকে থাকে, বাকিরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর এই টিকে থাকার জন্য কখনো কখনো প্রাণীরা স্বভাব চরিত্র বদলে ফেলে। এই পুরো বিষয়তাকে ডারউইন বললেন ‘সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট’ অর্থাৎ যার যোগ্যতা আছে, সেই টিকে থাকবে।
হুবুহু তাই ঘটল আমার পত্রিকা অফিসটিতে। আমাদের সেই ‘কম্পোজিটর’ নামক প্রজাতিটি ‘সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট’ এর চক্রে পড়ে গেল। তারা পড়িমড়ি করে শিখে নিতে শুরু করলেন কম্পিউটারের কাজ। তাদের কেউ কেউ বেশ ভালোই করলেন, খটোমটো সফটওয়্যারের কাজ করে ফেলতে লাগলেন সহজে। তাই টিকে গেলেন প্রতিযোগিতায়।
আর যারা পারলেন না যন্ত্রটিকে কাবু করতে, অবধারিতভাবেই তাদের সরে দাঁড়াতে হলো। কেউ গেলেন সার্কুলেশন শাখায়, কেউ বা বিল কালেকশন শাখায়। কিন্তু বাকিরা?
ভাবনা নেই। অ্যাডাম স্মিথের নিষ্ঠুর পরিণতি মেনে নিতে হয়নি তাদের। এখানেও ডারউইনের তত্ত্ব এসে বাঁচিয়ে দিল বাকিদের। কীভাবে?
চার্লস ডারউইন এর তত্ত্ব বলে, প্রকৃতিতে ব্যক্তিগত উন্নতির চেয়ে দলগত বা সার্বিক উন্নতি বেশি ভালো। কোনো একটা নির্দিষ্ট প্রজাতি টিকে থাকার চাইতেও অন্য একটা যোগ্য প্রজাতি টিকে গেলে যদি প্রকৃতির ভালো হয়, তবে সেটাই ভালো। আমাদের সেই ‘কম্পোজিটরদের’ জায়গায় আরও দক্ষ আর যোগ্য কর্মীরা নিয়েছেন বলেই প্রতিষ্ঠানটি উন্নতি করেছে। আর শেষ দৌঁড়ে সেটাই জরুরি।
তাদেরকে শ্রম আইন অনুযায়ী প্রভিডেন্ট ফান্ড আর সমস্ত বকেয়া পাওনাসহ বিদায় দেওয়া হয়েছে।
স্মিথের তত্ত্ব, উদারপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি হলো, বাজার তার অদৃশ্য হাত দিয়ে চূড়ান্তভাবে সব নিয়ন্ত্রণ করবে। এই তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ডারউইনের তত্ত্ব- ব্যক্তির পক্ষে যা ভালো তা সার্বিকভাবে দলের পক্ষে ভালো নাও হতে পারে।
অ্যাডাম স্মিথের দৃষ্টিতে, বাজার ব্যর্থ হয় যখন সুষম প্রতিযোগিতা থাকে না। তখন খুচরা বিক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ডারউইন দেখালেন, প্রত্যেকে সমান সুযোগ পেলেও বাজার ব্যর্থ হতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলে যায় বলগা হরিণদের কথা। বংশ বৃদ্ধির জন্য গাভীটিকে জয় করতে লড়াই করে ষাঁড়ের দল। যার গায়ে বেশি শক্তি সেই পাবে ভালোবাসা! আর এক্ষেত্রে তাদের জমকালো শিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেখতে সুপুরুষ তো বটেই, আবার লড়াইয়ে জিততেও শিং জরুরি।
আবার এই শক্তিশালী বলগা হরিণের দলই যখন শিকারীর সামনে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে দৌঁড়ে পালায়, তখন হয় বিপত্তি। যাদের শিং বেশি বড় তারা একজন আরেকজনের শিঙে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে প্রাণ হারায়।
অর্থাৎ সবচাইতে যোগ্যজন যেমন গাভীর ভালোবাসা পাচ্ছে, সেই শক্তিশালী জনই আবার বিরাট শিঙের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ছে মাটিতে।
অন্য কথায়, ডারউইন প্রতিযোগিতার গতিশীলতায় একটি সিস্টেমিক ত্রুটি দেখিয়েছেন- প্রতিযোগিতার অভাব থেকে ব্যর্থতা আসে না বরং প্রতিযোগিতার নিজের প্রয়োজন থেকেই ব্যর্থতা আসা দরকার।
রবার্ট ফ্র্যাংক যেমন এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বাজারে শেষ কথা বলে কিছু নাই, বরং প্রেক্ষাপটটাই জরুরি। কখন কোন বৈশিষ্ট্য যোগ্য আর জরুরি- সেটা দেখতে হবে।
ডারউইন যেমন বলেছেন, যে কোনো পরিবেশে টিকে থাকতে গেলে একটি প্রাণীকে একটা মাত্র লক্ষ্য নয়, বরং সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে বিকল্প লক্ষ্যগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত। যাচাই করতে হবে কোন লক্ষ্যগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনগুলো ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
যে কোনো ব্যবসার জন্যও এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মডেল। লক্ষ্য রাখতে হবে- চূড়ান্ত লক্ষ্য নয় বরং আপেক্ষিক লক্ষ্যগুলোর প্রতি, যা তাকে শেষ পর্যন্ত বাজারে বাঁচিয়ে রাখবে।
বলগা হরিণদের কথা ভেবে দেখুন, চাইলে আরও জমকালো আর বিরাট শিং গজানো যেত। এতে করে হয়তো আরও গাভীরা আকৃষ্ট হতো তাদের প্রতি, বংশ বাড়তো নিঃসন্দেহে। কিন্তু শেষ দৌঁড়ে টিকে থাকার জন্যই শিঙের আকার যত ছোট হয় ততই কিন্তু ভালো।
ব্যবসার ক্ষেত্রেও তাই, চাইলেই একটা প্রতিষ্ঠান তার যোগ্যতার বাইরে তরতর করে বাড়তে পারে না। অর্থনীতিতে এই চমৎকার ভারসাম্য বজায় থাকে- কোনো প্রতিষ্ঠান ঠিক তার দলের যোগ্যতা অনুযায়ী আর নয়তো তার পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বাড়ে। এর বেশি বাড়তে চাইলে নিজের ভারেই নিজে মুখ থুবড়ে পড়বে।
ডারউইন, সেই ২২ বছর বয়সী যুবক- যিনি নতুন পৃথিবীটা ভ্রমণ করতে বেরিয়েছিলেন, সংগ্রহ করে এনেছিলেন প্রাণী, অবাক চোখে প্রকৃতিতে দেখে ফিরে এসেছিলেন একটা অসাধারণ তত্ত্ব নিয়ে। যে তত্ত্ব শুধু প্রকৃতি আর জীবজগতের প্রতিই নয়, অর্থনীতি আর ব্যবসা নিয়েও বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকেই পাল্টে দিয়েছিলেন।
আজ এই মহান বিজ্ঞানী আর ‘অর্থনীতিবিদ’ এর ২১১তম জন্মদিন। জন্মদিনে ডারউইনকে ধন্যবাদ জানাই তার তত্ত্বের জন্য। তার এই তত্ত্বের কারণেই হয়তো আমার পুরানো অফিসের সেই ‘কম্পোজিটরদের’ ভুলে যাইনি আমরা। হয়তো টিকে থাকার প্রয়োজনেই তাদের হারিয়েছি আমরা, কিন্তু তাদের অবদানকে ভুলে যাইনি। অ্যাডাম স্মিথের আমলে হলে হয়তো ভুলে যেতাম।
(https://tbsnews.net/opinion/when-darwin-removed-adam-smiths-invisible-hand-my-workplace-43957)