এডিস মশাকে অন্ধ করা হয়েছে, সে আর আপনাকে দেখতে পাবে না!
জাদুর প্রদীপের কথা সবাই জানেন, যে প্রদীপের দৈত্য করে ইচ্ছেপূরণ। তেমন প্রদীপ যদি পান, আর দৈত্য শর্ত দেয় অতিপ্রাকৃত দুটি ক্ষমতা- উড়তে পারা বা অদৃশ্য হওয়া- এ দুইয়ের যেকোন একটি বেঁছে নিতে পারবেন, তাহলে কী করবেন?
অনেকেই হয়তো ওড়ার ক্ষমতাই চাইবেন, কিন্তু বিজ্ঞান বলছে অদৃশ্য থাকাই ভালো। তাতে অন্তত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণীকূল মশার হাত থেকে নিস্তার পাবেন।
তবে জাদুটোনা নয়, বিজ্ঞানই এনে দেবে সে ক্ষমতা। এনিয়ে গবেষণাও এগিয়ে চলেছে জোরতালে। পাওয়া গেছে প্রাথমিক সফলতাও।
এই প্রথমবারের মতো, ক্রিস্পার-কাস নাইন' নামক একটি জিন এডিটিং টুল ব্যবহার করে মানুষকে ভয়াবহ ডেঙ্গু রোগ বিস্তারকারী এডিস- ইজিপ্টি মশার চোখে অদৃশ্য করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।
এডিস- ইজিপ্টি মশা কালো বিন্দু সদৃশ অবয়বে মানুষ ও তার শিকার অন্য প্রাণীকে দেখতে পায়। বিজ্ঞানীরা জিন টুলের এ প্রজাতির মশার জিন এমনভাবে পরিবর্তন করেছেন, যাতে তাদের দুটি আলোকসংবেদনশীল রিসেপ্টর নষ্ট হয়ে যায়, ফলে দেখে শিকার করার ক্ষমতা হারায় পরীক্ষাধীন মশাগুলো।
সম্প্রতি গবেষণার এই চাঞ্চল্যকর তথ্য জার্নাল কারেন্ট বায়োলজি নামক একটি বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়াগোতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানী দল। এ গবেষণায় জড়িত নন, তবে এর অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা সেখানকার একজন পোস্টডক্টরাল গবেষক ড. নেহা ঠাকরে বলেন, মশার দৃষ্টিশক্তি কীভাবে কাজ করে তা বুঝতে এ গবেষণাকে তিনি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ মনে করছেন।
আর মনে না করার কারণও নেই, মানবজাতির জন্য ভয়াল আতঙ্কে রূপ নিয়েছে ডেঙ্গুবাহী মশার উপদ্রুপ। বাংলাদেশেও দিন দিন বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা।
বর্তমানে এক হাজার ৭২ জন ডেঙ্গু রোগী সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে ৮৫৭ জন রোগীকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ২১৫ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢাকার বাইরের হাসপাতালে।
গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৭৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। আজ সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য জানিয়েছে।
ডিম পাড়ার জন্য স্ত্রী মশার উষ্ণ রক্তপানের দরকার হয়, আর একাজ করতে গিয়ে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে ডেঙ্গু, পীতজ্বর ও জিকার মতো মারণব্যাধি। প্রতিবছর এসব রোগে আক্রান্ত হন লাখ লাখ বিশ্ববাসী। বিজ্ঞানীরা এসব রোগের জীবাণুকে ফ্লাভিভাইরাস বলেন।
গবেষণা নিবন্ধের প্রধান লেখক ড. ইনপেং ঝ্যান লিখেছেন, "মশার দৃষ্টিশক্তি কীভাবে কাজ করে সেটা যদি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি, তাহলে এর উৎপাত আমরা পরিবেশ সম্মতভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।'
তবে এডিস মশা নিয়ে তাদের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সফলতা নিয়ে উচ্ছসিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। যেমন; ম্যালেরিয়াবাহী অ্যানোফিলিস মশা রাত্রে শিকারের সন্ধান করে। অন্যদিকে, সুর্যালোকেই ভোর ও সুর্যাস্তের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিকার খোঁজে এডিস ইজিপ্টি। উষ্ণ রক্ত সন্ধানে অনেক ধরনের অনুভূতিকে কাজে লাগায় প্রজাতিটি। যেমন নিঃশ্বাসের সাথে কার্বন ডাই অক্সাইডের সূক্ষ্ম নিঃসরণের অনুভূতি পেলেই তারা বুঝতে পারে আশেপাশে কোন প্রাণী রয়েছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ করে।
গবেষণা নিবন্ধের আরেকজন লেখক ক্রেইগ মন্টেল বলেন, "এডিস মশা আমাদের ত্বক নির্গত তাপ, জলীয় বাষ্প ও গন্ধকেও কিছুমাত্রায় শনাক্ত করতে পারে। তবে পছন্দনীয় শিকার না পেলে মশা সোজাসুজি উড়ে গিয়ে সামনে যে অন্ধকার অবয়ব দেখতে পায়, তাকেই আক্রমণ করে।"
ইতঃপূর্বের বৈজ্ঞানিক গবেষণাতেও পাওয়া যায় এ ইঙ্গিত। ১৯৩৭ সালের এক পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দেখেন এডিশ মশা কালো কাপড় পরা মানুষের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। তবে এতদিন প্রজাতিটি যে মলিউকুলার ম্যাকানিজম ব্যবহার করে শিকারকে দেখতে পায়, সে সম্পর্কে এতদিন বিজ্ঞানের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এবার সেই জ্ঞান শূন্যতা পূরণের দুয়ার খুলে দিলেন নতুন যুগের গবেষকরা।
তাদের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে নির্দিষ্ট দুটি প্রোটিন প্রয়োগের মাধ্যমে এডিশ মশার কালো অবয়ব শনাক্ত করার ক্ষমতা নষ্ট করা সম্ভব। এরপর মশাটির অন্যান্য অনুভূতিও নিষ্ক্রিয় করার গবেষণা শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের আশা, জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত মশাকে প্রাকৃতিক পরিবেশে উন্মুক্ত করলে তারা একই প্রজাতির সঙ্গে প্রজননের মাধ্যমে দুর্বল বংশজের জন্ম দেবে। এভাবে বিশ্বব্যাপী মশকবাহী রোগ প্রতিরোধেও আসতে পারে উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস