এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৬৪ শিশু; দেরিতে শনাক্ত ও হাসপাতালে ভর্তি মূল কারণ
চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ থেকে ১৫ বছর বয়সী মোট ৬৪ জন শিশু মারা গেছে। আর গতকাল (৩০ ডিসেম্বর) পর্যন্ত হিসেবে মোট মারা গেছেন ৫৭৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে নারী ৫১.২ শতাংশ এবং পুরুষ ৪৮.৪ শতাংশ।
আর শিশুদের মধ্যে ২৬ জনের বয়স ৫ বছরের মধ্যে, ২২ জনের বয়স ৬ থেকে ১০ বছরের মধ্যে এবং ১৬ জনের বয়স ১১ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। দেরিতে রোগ শনাক্ত ও হাসপাতালে ভর্তির কারণে শিশু এবং নারীদের মৃত্যুর হার বেশি বলে উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, "শিশুদের মধ্যে লক্ষণগুলো বড়দের মতো স্পষ্টভাবে দেখা নাও দিতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে মারাত্মক ডেঙ্গুর লক্ষণ যেমন– ফ্লুইড লিকেজ, ব্লিডিং কিংবা শক নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।"
পানিশূন্যতা, প্রস্রাব কমে যাওয়া এবং শিশুর স্বাভাবিক চালচলনে কোনো পরিবর্তন দেখা মাত্রই অবিলম্বে চিকিৎসকের সহায়তা নিতে অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়েছেন ডা. ফজলে রাব্বি চৌধুরী।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম মুশতাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ডেঙ্গুর প্রাথমিক বিষয়টা হলো রোগ নির্ণয়। শিশু নিজের সমস্যার কথা বলতে পারেনা, তাই অনেক ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় দেরি হয়ে যায়।"
"আবার নারীরা কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করেন, তাই অবহেলা করে নারীকেও দেরিতে হাসপাতালে নেওয়া হয়। দ্রুত শনাক্ত না হওয়ায় ডেঙ্গুতে এখন মৃত্যুহার এমনিতেই বেশি, এক্ষেত্রে নারী ও শিশু আরও ভালনারেবল।"
ডা. মুশতাক আরও বলেন, "ডেঙ্গু রোগী এখন বছরব্যাপী থাকছে। এ বছর যেহেতু চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে, তাই আগামী বছর ডেঙ্গুর আউটব্রেক না হলে চিকুনগুনিয়া বা জিকা আক্রান্ত বাড়তে পারে। তাই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা প্রতিরোধে বছরব্যাপী এডিস নির্মূল কার্যক্রম চালাতে হবে স্থানীয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশনকে।"
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১,০১,১৩০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। গেল নভেম্বরে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৭৩ জন— যা এক মাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু।
এদিকে, গত ৪ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত এডিস মশার 'বর্ষা জরিপ' পরিচালনা করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।
জরিপে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৮.৮ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২৫.৬ শতাংশ বাড়িতে ডেঙ্গু সৃষ্টিকারী এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
সর্বোচ্চ ব্রুটো ইনডেক্স— এডিস লার্ভার উপস্থিতি পরিমাপক সূচক— মিলেছে ঢাকা দক্ষিণের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে; সেখানে এই সূচক ৭০। কীটবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই সূচক ২০-এর উপরে গেলেই তা মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
এ বছর এখন পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণে ২৩৮ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। কোনো সিটি কর্পোরেশনের অধীনে এটি সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক ডা. গোলাম সারোয়ার বলেন, "২০২৪ সালের সর্বশেষ মশা জরিপে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ডগুলোর ব্রুটো ইনডেক্স অনেক বেশি। তার মানে, মশার ঘনত্ব এখনও অনেক বেশি। নতুন বছরেও যে সংক্রমণের পরিমাণ বাড়বে, তা জরিপেই বোঝা যাচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "মশা মারতে আমরা যে কীটনাশক ব্যবহার করছি, সেগুলোর স্যাম্পল কালেক্ট করে টেস্ট করে দেখতে হবে কোনো ব্যত্যয় আছে কিনা, যেমন পরিমাণে কম বা বেশি অথবা রেজিটেন্স হয়েছে কিনা।"
"কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে প্রাসঙ্গিক উপায়ে, প্রয়োজনে বদলাতে হবে। জনবলকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত বছরের শুরতে নিয়ে সে অনুযায়ী কার্যক্রম চালাতে হবে," যোগ করেন তিনি।