করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষায় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের দিকে ঝুঁকছেন ভারতীয়রা
সভ্যতার ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠা ও মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় উদ্ভিদ জগতের অবদান তুলনাহীন। বারবার সেই সত্যকে নানা বিপর্যয়ে নতুন করে উপলদ্ধি করে মানুষ। বিশেষ করে, ভেষজের ঔষধি গুণ যুগ যুগ ধরে প্রমাণিত এক বিষয় এবং প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রধান অনুষঙ্গ।
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের পরই পৃথিবীর তৃতীয় শীর্ষ করোনাভাইরাস প্রভাবিত রাষ্ট্র এখন ভারত। ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় স্থায়ীভাবে সেরে ওঠার পদ্ধতি বা টিকা এখনও বাজারে আসেনি। তাই ভারতীয়রা বেছে নিয়েছেন ঘরে তৈরি ভেষজ উপাদানের নিরাপত্তা। সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকা এবং দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে- তারা ঝুঁকেছেন নানা প্রকার ভেষজ উৎস; লতা, গুল্ম, দানাদার ফল, মশলা ইত্যাদি ব্যবহারের দিকে।
দেশটিতে যখন করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ১৫ লাখের দিকে ধাবিত হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই জনপ্রিয়তা বাড়ছে ভেষজ বিজ্ঞানের।
করোনা সংক্রমণ বিস্তার রোধের অন্যতম প্রধান উপায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। কিন্তু, ভারতের মতো জনবহুল ও ঘনত্বের দেশে অধিকাংশ সময়; তা মেনে সুরক্ষিত থাকা বেশ মুশকিল। একারণেই, বাড়িতে কিভাবে ভেষজ উপাদান তৈরি করা সম্ভব- ইন্টারনেট ঘুরে তা জানার তীব্র প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভারতীয় নেটিজেনদের মধ্যে।
ঘরে দাওয়াই তৈরির সুপ্রাচীন এ ঐতিহ্যটি যেন, বর্তমান সঙ্কটে নতুন করে আবিষ্কার করছেন তারা।
গত মে'তে গুগল সার্চের উপর ভিত্তিতে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ব্যবহারকারী সার্চ ইঞ্জিনটিতে নানা প্রকার খাদ্যের ঔষধি গুণ জানতে চেয়েছেন। অবশ্য, আপনি যদি ভাবেন তারা মধু বা পুদিনা পাতা দেওয়া চায়ের উপকারিরতা জানার চেষ্টা করেছেন, তাহলে ভুল করবেন। দেশটির অধিকাংশ ব্যবহারকারী বরং ভেষজ বিজ্ঞানের আরও গভীর জীবনদায়ী উপাদানের গুণাগুণ সন্ধান করেন।
প্রাচীন ভারতে নানা প্রকার ভেষজের গুণাগুণ -শুধু আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের চর্চাকারীরাই জানতেন, সেই ইতিহাস ও ওষুধের প্রস্তুত প্রণালী জানার চেষ্টা বেশি বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
যেমন; আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির অসাধারণ গুণের জন্য 'গুলঞ্চ পাতা'কে স্বর্গীয় সুধা তৈরির প্রধান উপাদান হিসেবে উলেখ করেছেন সেকালের চিকিৎসকেরা। আবার 'কাঁধা' নামের আরেকটি লতা সর্দি-কাশি ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে বলে দাবি করেছেন তারা।
বর্তমানে ভারতীয়রা এসব ভেষজ থেকে কিভাবে ঘরে ওষুধ তৈরি করা যায়, তা জানতে সার্চ দিচ্ছেন গুগলে।
সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল:
ভারতে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা এমনিতেই বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। করোনায় সংক্রমিত হলে পরিণতি নিয়ে তাই উদ্বেগের শেষ নেই, দেশটির নাগরিকদের মাঝে। কিছু সরকারি হাসপাতাল তো আবার জরাজীর্ণ অবকাঠামো এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে রোগীও ভর্তি করছে না। মূলত; এসব কারণেই সাধারণ মানুষের মাঝে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভেষজের সাহায্যে সুরক্ষিত থাকার প্রচেষ্টা।
ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতা নিয়ে আগে থেকেই বেশ দুর্নাম রয়েছে। গত সপ্তাহে সামাজিক মাধ্যমে এমনই এক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে কোভিড-১৯ রোগীভর্তি কর্নাটক রাজ্যের একটি হাসপাতালে শূকর চড়ে বেড়াতে দেখা গেছে।
উত্তর প্রদেশের আরেক হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন ছাদ থেকে ঝর্নার গতিতে পানি চুইয়ে পড়ছে। ছাদের বৃষ্টির পানি নামার পাইপ নষ্ট থাকার কারণেই এহেন দুর্দশায় পড়েন তারা।
অন্যদিকে, বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ও পরিবেশ উন্নত হলেও; তা ব্যয়সাপেক্ষ। খরচের কারণে, সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং ধনীরাই সেখানে ভর্তি হওয়ার সক্ষমতা রাখেন। এসব উদ্বেগ ভারতীয়দের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টায় বাড়তি তৎপর হয়ে উঠতে প্রণোদনা দিচ্ছে।
ভেষজ খাদ্যপণ্যের বাজার বিকাশ:
ভোক্তাপণ্যের বাজারে এর প্রভাবটাও বেশ ভালোই লক্ষ্য করা যায়। দেশটির নানা বিমান বন্দরের লাউঞ্চে আজকাল সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় হয়ে উঠেছে, হলুদ বা জাফরান মেশানো দুধ।
চাহিদা অনুধাবন করে অনেক বেসরকারি কোম্পানি এ ব্যবসা থেকে মুনাফা লাভে উদ্যোগ নিচ্ছে। ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে দুধ সরবরাহকারী এমন একটি কোম্পানি এখন হলুদ মেশানো দুধ বিক্রির ব্যবসায় নেমেছে। আরেকটি কোম্পানি বিক্রি করছে হলুদ মেশানো আইসক্রিম।
ভারতের সবচেয়ে পুরোনো রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা বৃদ্ধিকারী আয়ুর্বেদিক হলো; চাওয়ানপ্রাশ। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এর বিক্রি তিনগুণ বাড়ে। ক্রেতাদের চাহিদা লক্ষ্য করে, প্রস্তুতকারক কোম্পানি ডাবর পরবর্তীতে এমন আরও ভেষজ পণ্যের সমাহার বাজারে আনে।
এর বাইরেও অনেক কোম্পানি ভেষজ পণ্য সমৃদ্ধ খাদ্যপণ্যের বাজার ধরার প্রতিযোগিতায় কোমর বেঁধেই নেমেছে।