কালা ভুনা থেকে সাতকড়া: বিলেতে বাংলাদেশি স্বাদ
১৮১০ সালে মেরিলিবোনের হিন্দুস্তান কফি হাউজ ছিল ব্রিটেনের প্রথম ভারতীয় রেস্টুরেন্ট। এর মালিক ছিলেন শেখ দ্বীন মুহাম্মদ নামের এক বাঙালি ভ্রমণপিপাসু ও উদ্যোক্তা, যিনি পরে নাম পাল্টে পরিচিত হন সেইক ডীন মাহোমেড নামে। নানা গুণে গুণান্বিত এই ব্যক্তিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংরেজি ভাষায় রান্নার বই প্রকাশ করেন এবং নিজের ভ্রমণের প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে নানা সমস্যায় পড়ে ১৮১১ সালে তিনি রেস্টুরেন্টটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
তবে ভারতীয় রেস্টুরেন্ট যে একটি সমৃদ্ধশালী ব্যবসা তা বলাই বাহুল্য। আর একে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বলা হলেও, আদতে ব্রিটেনের এই রেস্টুরেন্টগূলোর ৯০ শতাংশেরই মালিকানা কিংবা ব্যবস্থাপনা এখন বাংলাদেশিদের হাতে। কিন্তু ব্রিটিশ-বাংলাদেশি মিলিয়ে ৬ লাখ বাসিন্দা থাকার পরেও ব্র্যান্ড হিসেবে ব্রিটেনে বাংলাদেশের নামটা যথেষ্টই ফিকে। খুব কম সংখ্যক রেস্টুরেন্টই নিজেদের পুরোপুরি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট নামে পরিচয় দেয়।
কভেন্ট গার্ডেনে যখন আমরা টিতুলিয়ার যাত্রা শুরু করতে যাই তখন আমরা একে একটি বাংলাদেশি টি বার হিসেবেই পরিচয় দিতে চেয়েছি। আমরা ব্রিটেনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা বদলে দিতে চেয়েছিলাম। মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা আমাদের তখন নিষেধ করেছিল, তাদের পরামর্শ ছিল বাংলাদেশকে মূল কেন্দ্রে না রাখার, কারণ তাদের মতে বাংলাদেশকে খুব কম মানুষই বিশ্বের মানচিত্রে চেনে। আর চিনলেও বাংলাদেশ নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই নেতিবাচক খবরই পাওয়া যায়। বাংলাদেশ নিয়ে সংবাদের বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে দুর্যোগের খবর।
সেই তুলনায় ইন্ডিয়ান বা ভারতীয় নামে নামকরণ হলে বিক্রিবাট্টা সহজ হবে। এসবই ছিল পরামর্শ।
ব্রিটেনে আমরা বহুদিন ধরেই ভাবি যে ভারতকে আমরা চিনি, সেই ভারতবর্ষে বৃটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের শাসনামলের সময় সংঘটিত শোষণ ও নিপীড়ণের কথা আমরা ভুলে থাকতেই পছন্দ করি। বরং সাংস্কৃতিক আলোকছটা দিয়ে রাজ প্রেমের নামে একে কীভাবে ঢেকে রাখা যায় সেই চিন্তাই করি। ফলে বহু ব্যবহৃত ও সুপরিচিত সাজসজ্জার মাধ্যমে ইন্ডিয়ান নামে পরিচিত রেস্টুরেন্টগুলো এতটাই বাঁধাধরা হয়ে গেছে যে তার সঙ্গে ইংরেজ বা ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতি কিংবা খাবারের সত্যিকার কোনো যোগসূত্র খুব কমই আছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু তরুণ উদ্যোক্তা বৃটেনের কারি মার্কেটে একটা ফাঁকি স্থান লক্ষ্য করেছেন, এবং তারা সেখানে প্রতিযোগিতায়ও নেমে গেছেন। ডিশুম, জিমখানা, তৃষ্ণা, দার্জিলিং এক্সপ্রেসের মত বেশকিছু রেস্টুরেন্ট এখন ভালো মানের প্রকৃত বাংলা রান্না পরিবেশন করছে এবং সাফল্যও পাচ্ছে।
তারপরও যুক্তরাজ্যে ভারতীয় রান্নার পথিকৃৎ হিসেবে বাংলাদেশিরাই থাকলেও, এখনো এখানে আসল বাংলাদেশি সংস্কৃতির কোন রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠতে দেখা যায় না।
অনেকে বলতে পারেন যে বাংলাদেশি রান্নায় তেমন স্বতন্ত্রতা নেই, কিন্তু তা সত্যি নয়। লন্ডনের পূর্বাংশে আমরা এর ব্যতিক্রম দেখতে পাই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রিক লেনের গ্রাম বাংলা ও আমার গাঁও, হোয়াইটচ্যাপেলের কলাপাতা রেস্টুরেন্ট, যারা নিজেদের বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট বলে পরিচয় দেয়। এরকম আরো বেশকিছু পাওয়া যাবে গোটা বৃটেন জুড়েই।
চট্টগ্রামের কালা ভুনা ও মেজবানি বিফ, যশোরের চুইঝাল, সিলেটের সাতকড়ার তরকারি এবং পুরান ঢাকার বিরিয়ানি ও বাকরখানির মত রান্নাগুলো তাদের রেসিপিতে রয়েছে যা মুঘল আমলের হেঁসেল থেকে এসেছে আমাদের কাছে। এগুলো আমাদের বাংলাদেশি রন্ধনশালাকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করেছে।
যুক্তরাজ্যে বর্তমানে ৮ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কিন্তু তারা তাদের ব্যবসায়িক নামে 'ইন্ডিয়ান' কথাটা বাদ দিতে ভীত, নাম বদলালে লোকসানের মুখে পড়বেন কিনা তা নিয়ে চিন্তিত। তবে যারা বদলেছেন বাণিজ্যিকভাবে বলতে গেলে, তারা হয়তো হপারস, কলাম্বা বা সোহোতে অবস্থিত প্যারাডাইস ও শ্রীলঙ্কান নামসম্বলিত রেস্টুরেন্টগুলো থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন।
ডায়াস্পোরিক বাংলাদেশিরা যদি নিজেদের নামের প্রসার ঘটাতে চান তাহলে তারা একটু পেছনের ইতিহাসের দিকেও তাকাতে পারেন, অনুপ্রেরণা নেয়ার জন্য। একসময় অসম্ভব বলে মনে করা হলেও বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোর দিক দিয়ে বিশাল প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। সেটা যদি যথেষ্ট না মনে হয়, তাহলে বলতে হবে যে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সূত্রমতে, বাংলাদেশে জেন্ডার সমতা বিষয়ক স্কোর যুক্তরাষ্ট্রের চাইতেও বেশি। সেই সাথে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট আসার ফলে এবং কৃষক আন্দোলনের পর মোদির ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের মুক্তচিন্তার ধারণা থেকে খানিকটা পিছলে গেছে বলেও মনে করা হচ্ছে। এই মাসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। সময়ের সাথে আমাদের দেশের সংস্কৃতি, সঙ্গীত এবং সাহিত্য আরো বেশি উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
তবে খাদ্যের দিক থেকে যে হাওয়াটা বদলে যেতে শুরু করেছে টিভিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। টিভিতে গ্রেট ব্রিটিশ বেক অফ উইনার নাদিয়া হুসাইন ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (যাদের এক্সিকিউটিভ সব সদস্যই পুরুষ!) চাইতেও জোরালোভাবে দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে পেরেছেন।
কিছু ব্যবসা ক্ষেত্র এখন বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের পরিচয় থাকাকে বরং অন্য ব্যবসাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এর মধ্যে আছে কারি কিট কোম্পানি 'ব্যাং কারি' যারা তাদের প্যাকেজিং এ গর্বের সঙ্গেই বাংলাদেশের নাম লেখে। তাদের রেসিপিগুলো বাংলাদেশের এবং এদেরকে অন্য অনেকে হয়তো ইন্ডিয়ান বলেই বাজারজাত করত। এরা তা করেনি।
তবে আশার কথা হচ্ছে একটা সুন্দর গল্প বলার জন্যে ব্যবসাক্ষেত্রে সাহসী হওয়ার ও ঝুঁকি নিতে শেখার এটা সবেমাত্র আরম্ভ।
ইন্ডিয়ান বা শ্রীলঙ্কা নয়। এখন পুরো বিষয়টি বৃটেনের নতুন প্রজন্মের হাতে, তারা বিশ্বকে বাংলাদেশের নাম চেনাবে কিনা।
- দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত আহসান আকবরের নিবন্ধ অবলম্বনে।
- অনুবাদ: খুশনুর বাশার জয়া