ঘ্রাণেই অর্ধভোজন: উপমহাদেশের রান্নায় সুগন্ধি ব্যবহারের গল্প
ঘ্রাণেই অর্ধভোজন বলে একটা কথা আছে। খাবারের ক্ষেত্রে স্বাদের পাশাপাশি গন্ধটাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অনেকের কাছে। ভারতবর্ষে এ ব্যাপারে এগিয়ে ছিলেন মোগলেরা। খাবারের সুগন্ধ বিষয়ে তারা এতটাই উৎসাহী ছিলেন যে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে শাকসবজির চাষ করা হতো মোগল আমলে। অবিশ্বাস্য শোনালেও মোগলরা আসলেই তাদের শাকসবজির জমিতে গোলাপ আর কস্তুরী মিশ্রিত পানি দিয়ে সেচ দিতেন- যাতে রান্নার পর ওই খাবার থেকে মনমাতানো সুগন্ধ পাওয়া যায়।
মোগলেরা তাদের মুরগি পালন করতেন জাফরান ও গোলাপজলে ভেজানো রুটির গুড়োর মধ্যে। চন্দন ও কস্তুরী দিয়ে মুরগির গা দলাইমলাই করা হতো। রাজপ্রাসাদের রাজকীয় বাগানে কিছু বিরল প্রজাতির ফুলের চাষ করা হতো। সেগুলো থেকে তৈরি হতো বিলাসবহুল আতর। সে আতরের কোনো কোনোটি চলে যেত মোগল রসুইখানা মাতবাখ-এ।
রাজপরিবারের সদস্যরা যখন খেতে বসতেন, তখন ঘরের দেওয়ালে অগুরু বা কর্পূরের ধূপ জ্বালানো হতো। খাবারের মধ্যে খানসামারা আবার জাফরান, গোলাপজল, কমলা ফুল থেকে তৈরি সুগন্ধি পানীয়, কস্তুরী ইত্যাদিও অল্প পরিমাণে ছিটিয়ে দিতেন বাড়তি সুঘ্রাণের জন্য।
ধারণা করা হয়, উপমহাদেশের মোগলসহ অন্যান্য মুসলিম শাসকেরা খাবারের ঘ্রাণ নিয়ে তাদের আগ্রহ লাভ করেছেন তুরস্ক, ফার্সি, ও আরবি ভোজনবিদ্যার ঐতিহ্য থেকে। এসব অঞ্চল থেকে লেখা হয়েছে এমন কয়েকটি রান্না বিষয়ক বই হলো- ১০ম শতাব্দীর ইবনে সায়ার আল ওয়ারাক'র কিতাব আল-তাবিখ, ও ১৩ শতকের আল-বাগদাদি'র কিতাব আল-তাবিখ নামের আরেকটি। এ বইগুলোতে রান্নার স্বাদের পাশাপাশি সুঘ্রাণের বিষয়েও জোর দেওয়া হয়েছে।
বই দুটিতে উল্লেখ করা নানা রন্ধনপ্রণালীতে বিভিন্ন প্রকার সৌরভ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষত, খাবার রান্না শেষে গোলাপজল ছিটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি খুব গুরুত্ব পেয়েছে। পাঠকদের উপদেশ দেওয়া হয়েছে রান্নার হাঁড়ি-পাতিল ও অন্যান্য তৈজসপত্রে কস্তুরী, অম্বর, ও স্পিকেনার্ড (হিমালয়ে জন্ম নেওয়া সুগন্ধি গুল্মবিশেষ) দিয়ে সুগন্ধমোদিত করার জন্য।
নি'মাত্নম নামের আরেকটি রান্নাবিষয়ক বই ১৫ শতকের শেষ দিকে লেখা হয়। এ বইটিতে রান্নায় সুঘ্রাণ বাড়ানোর জন্য হিং, সুগন্ধি ফুল, কস্তুরী, অম্বর, অগুরু, স্পিকেনার্ড ইত্যাদি ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে কেবল মোগল বা আরবেরা নয়, বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই খাবারের সুঘ্রাণকে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। খাবারের সুঘ্রাণ যেমন এর নান্দনিকতা বাড়ায়, তেমনি স্বাদকে করে তোলে আরও বেশি উপভোগ্য।
ভালো খাদ্য বোঝার নাক
উপমহাদেশে খাবারের ঘ্রাণ বিষয়ে মোগলদের চেয়ে কোনো অংশে কম যেতেন না নবাবেরাও। আউধের নবাবদের রান্নাঘরে আতর ব্যবহার করতেন খানসামারা। গোলাপজল, কেওড়ার জল, আতর এসব ছিল নবাবী রান্নার অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাবারে সুগন্ধির সেই ঐতিহ্য আজও লক্ষ্ণৌর রন্ধনপ্রণালীতে টিকে আছে।
রাজা-বাদশা বা নবাবদের রাজকীয় রান্নাঘরের বাইরেও সুগন্ধি খাবারের দেখা মিলতো। যেমন, গুরাভালি নামের একটি খাবার তৈরি করা হতো বিচিত্র এক উপায়ে। রাতের বেলা মিষ্টি পুরভর্তি তেলেভাজা ময়দার তালের ভেতর জুঁই ফুলের কুঁড়ি ভরে দেওয়া হতো। সকালে ওই পিঠা খাওয়ার জন্য পরিবেশন করা হতো। ততক্ষণে পিঠার ভেতরে কুঁড়ি থেকে ফুল তৈরি হয়ে যেত, সেই ফুলের গন্ধে ভেতরটা ম-ম করতো।
দক্ষিণ ভারতে যেকোনো পায়েস, ক্ষীর বা মিষ্টান্ন জাতীয় খাবারে কর্পূর মেশানো হয়। অবশ্যই এ কর্পূর খাওয়ার যোগ্য। দক্ষিণের আরেকটি খাবার পানাগামে কর্পূর, তুলসী, শুকনো আদার সাথে গুড় মিশ্রিত পানি থাকে। পূর্বদিকে উড়িষ্যার দিকে গেলে পানা নামের আরেকটি সুগন্ধিযুক্ত পানীয়র দেখা মেলে। পানা তৈরির উপাদানের মধ্যে রয়েছে গুড়, দুধ, দই, ছানা, নারকেল, কলা, এলাচ, জায়ফল, কর্পূর ইত্যাদি। এ পানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও ব্যবহার করা হয়।
মানুষের মতো দেবতারাও তাদের খাবার সুবাসিত পছন্দ করেন। দেবতার ভোগেও কর্পূর ইত্যাদি সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। রাজস্থানের শ্রীনাথজির মন্দিরে থর নামক কর্পূর মিশ্রিত এক ধরনের পিঠা নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় দেবতার উদ্দেশে। তামিলনাড়ুর শ্রীরঙ্গম মন্দিরের নৈবদ্যের নাম আনুর সাত্তি আরাভানাই। এটি ক্ষীরের মতো এক প্রকার খাবার। এলাচ, জাফরান, ও কর্পূর দিয়ে এর সুগন্ধ বাড়ানো হয়।
পুরানো পুথি
জেইমস ম্যাকহিউ তার স্যান্ডালউড অ্যান্ড ক্যারিসন: স্মেল ইন ইন্ডিয়ান ফুড অ্যান্ড কালচার (২০২২) গ্রন্থে লিখেছেন, 'মধ্যযুগের ইউরোপীয় আলোচনায় ভারত পরিচিত ছিল মশলার দেশ হিসেবে, জান্নাতের সুগন্ধ হিসেবে।' সে সময় ভারতের চন্দনকাঠ, কস্তুরী, কর্পূর, জাফরান, লোবান, ও অম্বর ব্যবসায়িক পণ্যদ্রব্য হিসেবে পৃথিবীর সব অঞ্চলের দিকেই পৌঁছাত।
প্রাচীন ভারতের অনেক শাস্ত্রে পারফিউম তৈরি ও চিকিৎসাকাজের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন সুগন্ধিদ্রব্যের কথা জানা যায়। চরক সংহিতায় সর্বগন্ধা নামে এক ধরনের সুগন্ধি ঔষধের শ্রেণীর কথা উল্লেখ আছে যার মধ্যে রয়েছে চন্দনকাঠ, অগুরু, কাবাব চিনি, নীরস দারুচিনি ইত্যাদি এবং লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচ জাতীয় মসলা।
কালক্রমে এ সুগন্ধিদ্রব্যগুলোর অনেকগুলোই চিকিৎসা, সুগন্ধিদ্রব্য তৈরির পাশাপাশি ভারতবর্ষীয় রান্নাবান্নাতেও জায়গা করে নিয়েছে। তবে সে সময়েও খাবারে সুগন্ধির ব্যবস্থা করাটাও এক ধরনের বিলাসিতা ছিল। কেবল ধনী ও ভোজনরসিকেরাই সুগন্ধিযুক্ত খাবার আস্বাদন করতে পারতেন।
মহাভারতের আমলেও রান্নাবাড়ায় সুগন্ধির ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতের রান্নাবান্না বিষয়ক লেখা পাক দর্পণম-এ মহাভারতে উল্লেখিত নিষিধ রাজ্যের রাজা নালা'র সময়কার খাবারে কর্পূর, কস্তুরী, স্ক্রু পাইন, হিং, নাগকেশর, কেতকী ফুল ইত্যাদি ব্যবহারের কথা জানা যায়।
যে ঐতিহ্য আজও বহমান
শতশত বছর পরে আজও উপমহাদেশের রান্নাঘরগুলোতে হিং-এর অহরহ দেখা মেলে। আয়ুর্বেদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রাচীন ভারতের অনেক সর্বগন্ধা উপাদান বর্তমান সময়ে বিভিন্ন গরম মসলাতে পাওয়া যায়।
এ অঞ্চলে সুগন্ধিযুক্ত পাতায় খাবার মুড়িয়ে রাখার চর্চা এখনো রয়েছে। এই পাতাগুলো যেমন খাবারের পাত্র হিসেবে কাজ করে, তেমনিভাবে খাবারে এগুলোর সুগন্ধও মিশে যায়। এই যেমন কর্ণাটকের মুদ ইডলি বানানো হয় স্ক্রু পাইনের পাতায় ভাপ দিয়ে।
উত্তরাখণ্ডের সিংগাউরি নামক মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার মালু পাতায় মুড়িয়ে পরিবেশন করা হয়। ওই পাতার কর্পূরের ন্যায় সুগন্ধ খাবারের সাথে মিশে যায়। ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে ঘুরলে এরকম আরও নানা খাবারের কথা জানা যাবে যেগুলোর সাথে সুগন্ধ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে স্থান দখল করে আছে।
- সূত্র: স্ক্রল ডটইন