কোভিড টিকার একক ডোজ কতটা কার্যকর?
গেল ডিসেম্বরের শেষে কিডনি ইনফেকশন নিয়ে যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৮৫ বছরের কলিন হর্সম্যান। একই হাসপাতালে কোভিড আক্রান্ত রোগীরাও চিকিৎসাধীন ছিলেন। আর ভর্তির কিছুদিন পর কলিন নিজেও তাতে আক্রান্ত হন। অবস্থার অবনতি হলে তাকে জরুরি বিভাগে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়। কিন্তু, শেষ রক্ষা হয়নি, ক'দিন পরই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
আগে থেকেই অসুস্থ এবং বয়স্ক কলিনের মৃত্যু স্বাভাবিক দৃষ্টিতে কোভিডে প্রচলিত মৃত্যুর মতোই মনে হতে পারে। তবে বাস্তবে তা ছিল আরও বড় ঘটনা। তার পুত্র স্থানীয় সংবাদপত্রকে জানান, প্রথম দফায় ফাইজার ইঙ্কের টিকা যেসব বয়োবৃদ্ধ পেয়েছেন তাদেরই একজন ছিলেন তার বাবা। মৃত্যুর মাত্র তিন সপ্তাহ আগে তিনি টিকাগ্রহণ করেন। স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটার দিন দুয়েক আগে তার দ্বিতীয় ডোজ পাওয়ার কথা ছিল।
অর্থাৎ, ফাইজার/ বায়োএনটেক আবিষ্কৃত উচ্চ-সফলতার হার থাকা টিকার একটি ডোজ কলিনের মতো দুর্বল স্বাস্থ্যের ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারেনি।
বাস্তবতা বলছে, বুস্টার ডোজ ছাড়া সফলভাবে রোগ প্রতিরোধ করতে পারে না বেশিরভাগ টিকা। এই বুস্টার ডোজ টিকা ভেদে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বার গ্রহণ করতে হয়। এটি প্রথম ডোজের সক্ষমতাকে চাঙ্গা করে তুলতে সাহায্য করে।
শুধু কোভিডের মতো নতুন রোগের জন্যে নয়, এর আগে হাম, মাম্পস এবং রুবেলা'র জন্য আবিষ্কৃত এমএমআর ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখা গেছে। বিশ্বব্যাপী শিশুদের প্রাণঘাতী রোগগুলো থেকে বাঁচাতে টিকাটি দেওয়া হয়। এদের মধ্যে যারা এক ডোজ করে পেয়েছে তাদের ৪০ শতাংশ জীবাণু সংক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি। সেই তুলনায় দ্বিতীয় ডোজ পাওয়াদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ সংক্রমণের শিকার হয়।
এছাড়া, প্রথম দলের শিশুদের মধ্যে হামে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে দ্বিতীয় ডোজ পাওয়াদের থেকে চারগুণ বেশি। এজন্যেই, বিশ্বের নানা প্রান্তে যেখানে দুর্বল অবকাঠামোর কারণে এমএমআর ভ্যাকসিনের সব ডোজ দেওয়া যায়নি, সেখানে নতুন করে প্রাদুর্ভাবও দেখা দেয়।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ- এর টিকা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড্যানি অ্যালতম্যান জানান, "শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উন্নত করে জীবাণুর বিরুদ্ধে তুলনামূলক স্থায়ী সুরক্ষা গড়ে তোলার শক্তির জন্যেই বিশেষজ্ঞরা বুস্টার ডোজকে একান্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন।"
বুস্টার টিকা কীভাবে কাজ করে?
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন কোনো টিকার সংস্পর্শে প্রথমবার আসে, তখন সে দুই ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি করে। এদের মধ্যে প্রথমে তৈরি হয় প্লাজমা বি-সেল, যা মূলত অ্যান্টিবডি তৈরির দিকে মনোযোগ দেয়। এই কোষের স্থায়িত্ব বেশিদিন থাকে না। ফলে প্রথম ডোজের পর শরীরে বিপুল পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ডোজ ছাড়া তা বেশিদিন থাকে না। বরং ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।
প্রথম ডোজের পর দ্বিতীয় যে শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি হয়, সেটি হচ্ছে টি-সেল। এটি মূলত নির্দিষ্ট কোনো জীবাণু শনাক্ত করে তাকে আক্রমণের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে। এটি শরীরে কয়েক দশক সময় পর্যন্ত অবস্থান করতে পারে এবং ওই জীবাণু টিকাগ্রহীতার দেহে দীর্ঘসময় পর আবার আক্রমণ করলে তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, টিকাগ্রহণের মাধ্যমে পাওয়া সুরক্ষা একজন ব্যক্তি সারা জীবন পেতে পারেন। তবে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার আগে এধরনের শ্বেতকণিকা যথেষ্ট সংখ্যায় তৈরি হয় না। সোজা কথায়; আজীবন সুরক্ষার জন্যেই দ্বিতীয় ডোজ একটি আবশ্যক উপাদান।
বুস্টার ডোজ জীবাণুর অ্যান্টিজেনের সঙ্গে শরীরের কোষগুলোর পুনঃপরিচিতি ঘটায়। এবং তারফলে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা নতুনভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে, আলোচিত দুই স্তরের সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। অ্যালতম্যান বলেন, "সব ডোজ গ্রহণ করলে আপনার দেহে মেমোরি টি-সেল বহুগুণে বেড়ে যাবে। আর মেমোরি বি-সেল এত পরিমাণ তৈরি হবে, তা যেন এক প্রতিষেধকের সুইমিং পুলের সমান। এরা শরীরে অনেক উন্নতমানের অ্যান্টিবডি তৈরিতেও সহায়তা করবে।"
একই টিকার দ্বিতীয় ডোজে প্রথমবার তৈরি হওয়া বি-সেল গুলো অনেক দ্রুত বিভাজিত এবং নতুন করে উৎপন্ন হওয়ার শক্তি পায়। তারা এমন এক বংশবিস্তারের ধারা তৈরি করে যার ফলে রক্তে প্রবাহিত অ্যান্টিবডির মাত্রাও বেড়ে যায়।
- সূত্র: বিবিসি ফিউচার