তাপপ্রবাহে ওষুধের গুণগত মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা
দেশে চলমান তাপপ্রবাহের কারণে জরুরি ওষুধের কার্যকারিতা বা গুণমান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন ওষুধ বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিতে কোল্ড চেইন মেইনটেইন করা অনেক জরুরি। ব্লাড প্রডাক্ট, ভ্যাকসিন-জাতীয় ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের কিট ৪ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। এছাড়া অন্যান্য ওষুধ ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা যায়।
এদিকে, অধিকাংশ ওষুধের প্যাকেটের গায়ে ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণের নির্দেশনা থাকলেও, গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপমাত্রা ৩৯-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। উপরন্তু, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘক্ষণ লোডশেডিং দেখা দেওয়ায় ফার্মেসিগুলোতে নির্দেশিত তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না।
এরইমধ্যে শনিবার (২০ এপ্রিল) পাবনা ও চুয়াডাঙ্গায় দুইজন হিটস্ট্রোকে মারা গেছে। হিটস্ট্রোক মোকাবেলায় চিকিৎসা গাইডলাইন তৈরি, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, দেশে দুই লাখ ফার্মেসির মধ্যে এক লাখ ফার্মেসিতে এসি (এয়ার কন্ডিশনার) নেই। তাই তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলেই কার্যকারিতা কমে যায়।
"তাপমাত্রা বাড়ার কারণে রেফ্রিজারেটরে রাখতে হয়– এমন ওষুধ কার্যকারিতা হারাবে। এগুলো আবার মূল্যবান এবং জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে অধিকাংশ জায়গায় দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ থাকছেনা, সে কারণে রেফ্রিজারেটরে রাখা ওষুধও নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে," বলেন তিনি।
ডা. সায়েদুর রহমান আরও বলেন, "ফার্মেসিওয়ালাদের তো নিয়ন্ত্রণ করা যায়না, কিন্তু বাসায় ওষুধের মান ঠিক রাখতে মানুষকে সচেতন হতে হবে। দুরারোগ্যে আক্রান্তদের বাসায় যে ওষুধ থাকে, সে ওষুধ যেনো আগামী এক সপ্তাহে তুলনামূলক কম তাপমাত্রায় রাখা যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।"
সংশ্লিষ্টরা জানায়, যেকোন ওষুধ বাজারে আনার আগে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ও ৭৫ শতাংশ হিউমিডিটি পর্যন্ত রেখে স্থিতিশীলতা পরীক্ষা (স্ট্যাবিলিটি স্টাডি) করা হয়। এ পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা হয়, এই তাপমাত্রায় ওষুধের স্ট্যাবিলিটি কি পরিমাণ নষ্ট হয়, তারপর মেয়াদ ঠিক করা হয়।
বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ফার্মাসিউটিক্যাল প্রফেশনালের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. এএসএম আনসারুল ইসলাম বলেন, "আমরা ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ওষুধ রেখে গবেষণা করি। কিন্তু এখন হিটওয়েভের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি ১৫-২০ দিনের বেশি চললে প্রোডাক্টে দুই রকমের সমস্যা হবে। সিরাপের রং নষ্ট হয়ে যাবে, ক্যাপসুলের শেড নরম হয়ে যাবে এবং দীর্ঘস্থায়ী গরমের কারণে প্রোডাক্টের কার্যকারিতা কমে যাবে।"
তিনি আরও বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো ফ্রিজিং কাভার্ড ভ্যানে করে ওষুধ ডেলিভারি দেয়, কিন্তু দোকানে যাওয়ার পর ফার্মেসির দায়িত্ব তা নিয়ন্ত্রণ করা। যদিও অধিকাংশ ফার্মেসি তা করেনা।
"মডেল ফার্মেসিতে এসি, রেফ্রিজারেটার থাকে, কিন্তু দেশে মডেল ফার্মেসি অনেক কম। ওষুধের দোকানগুলো তাপমাত্রা মেইনটেইন করছে কিনা তা মনিটরিং করার দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। যে দোকানে ফ্যান, এসি, ফ্রিজ আছে– সেসব দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হবে," যোগ করেন তিনি।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে প্রায় দুই লাখের মত ফার্মেসি আছে এরমধ্যে মডেল ফার্মেসি আছে প্রায় ৮০০টি। ঢাকাসহ সারাদেশে টিনশেড অনেক দোকানে ওষুধ বিক্রি করা হয়, যেগুলোতে এসি বা রেফ্রিজারেটর কিছুই নেই। স্বাভাবিক সময়ে সেসব দোকানের ওষুধের কোল্ড চেইন ঠিকমত মেইনটেইন করা হয় না, সেখানে হিটওয়েভের এই সময়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম ফারুক বলেন, "গরমে ওষুধের মেয়াদউত্তীর্ণ হওয়ার আগেই মেয়াদ নষ্ট হয়ে যায়। আমরা বারবার বলে আসছি ফার্মেসিগুলোতে যেনো এসি রাখে। তা না হলে দোকানদারের অজান্তেই ওষুধের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাবে।"
তবে চলমান তাপপ্রবাহে ওষুধের মানে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক আশরাফ হোসেন। তিনি বলেন, "আমরা ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ওষুধ রাখতে বলি, কিন্তু সাধারণত ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ওষুধের স্টাবিলিটি স্টাডি করা হয়। তাই ২-৫ দিনের হিটওয়েভে তেমন কোনো সমস্যা হবেনা। বর্তমান হিটওয়েভে এখনও ওষুধের মান নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছেনা, কারণ বেশিরভাগ ফার্মেসিতে এসি, ফ্যান আছে। ফ্যান চালিয়ে রাখলেও টেমপারেচার কমে যায়। আমরা মনিটরিং করে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা পাইনি।"
তাপপ্রবাহ মোকাবেলায় চিকিৎসা গাইডলাইন তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
তীব্র তাপদাহের কারণে সারাদেশে জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, হিটস্ট্রোকসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা টিবিএসকে বলেন, হিটস্ট্রোক মোকাবেলায় চিকিৎসা গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে, সেটি সারাদেশের চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো হচ্ছে, চিকিৎসকদের ট্রেনিং দেওয়া হবে।
"এছাড়া হিটস্ট্রোকের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছি আমরা। হিটওয়েভজনিত রোগ থেকে বাঁচতে ঘরে থাকতে হবে এবং বেশি বেশি পানি পান করতে হবে," যোগ করেন তিনি।