কোভিড-১৯ যেভাবে মস্তিষ্কে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে
কোভিড-১৯ মহামারির শুরুর দিকে আক্রান্ত রোগীরা হঠাৎ স্বাদ ও গন্ধ না পাওয়ার মতো উপসর্গের কথা জানাতে থাকে। সার্স-কোর্ভ-২ ভাইরাস মানবদেহের স্নায়ুকে আক্রমণ করতে পারে, ফলে মস্তিষ্ক থেকে নাক ও স্বাদগ্রন্থিতে সংকেত পৌঁছানো ব্যাঘাতপ্রাপ্ত হয়।এব্যাপারটিই দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয় স্নায়ু বিশেষজ্ঞদের।
গ্লেন বিগস ইনস্টিটিউটস ফর আলঝেইমারের বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস হেলথ সায়েন্স সেন্টারের স্নায়ুজনিত রোগ বিশেষজ্ঞ ড. গ্যাব্রিয়েল ডে এরাসকুইন জানান, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল বিজ্ঞানীদের।
বিশেষজ্ঞদের এ আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ভাইরাস মস্তিষ্কে সরাসরি আক্রমণের চেয়ে; দেহে ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে দেহ ও মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়াই এক্ষেত্রে বেশি প্রভাব ফেলছে এমনটাই দেখা গেছে।
কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অনেক রোগীই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় তাদের মধ্যে মস্তিষ্কে আঘাতের মতো উপসর্গ দেখা যায়। এর মধ্যে আছে সাময়িক বিস্মৃতি যার ফলে অনেকের দৈনন্দিন কাজেও ব্যাঘাত ঘটে।
ড. এরাসকুইন জানান, অনেকেই তাদের দৈনিক কাজে ব্যঘাত হচ্ছে এমন উপসর্গের কথা জানিয়েছে, এমনকি খাবার প্রস্তুত করার মতো দৈনন্দিন কাজেও অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন এমন সমস্যার কথাও জানিয়েছেন অনেক রোগী।
কোভিড-১৯ এর কারণে খিঁচুনি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের মনোব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও আছে অনেক। আলঝেইমার অ্যান্ড ডিমেনশিয়া জার্নালের এক গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়েছে। গবেষণাটির গবেষক দলের সদস্য ড. এরাসকুইন জানিয়েছেন, অনেক রোগীর কোভিড-১৯ এর আক্রান্ত হওয়ার ফলে আলঝেইমারে আক্রান্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
অনেক রোগীই সেরে ওঠার সাথে সাথে তাদের স্নায়বিক উপসর্গগুলোও কমে আসতে থাকে, তবে অনেকের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। আক্রান্তদের মধ্যে এধরণের উপসর্গের হার খুব বেশি না হলেও, এধরণের উপসর্গে ভোগা রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি।
ঠিক কীভাবে কোভিড-১৯ মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলে এব্যাপারে এখনো গবেষণা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
মহামারির প্রথম দিকে সংক্রমণের ফলে অনেক রোগীর দেহে রক্ত জমাট বেঁধে স্ট্রোক হওয়ার মতো আশঙ্কাও দেখা যায়। ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছালে, ফুসফুস পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারেনা এবং তখন অনেক রোগীর মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিকাল ডিজঅর্ডার অ্যান্ড স্ট্রোকের ড. অভিন্দ্র নাথ জানান, এ ব্যাপারগুলো সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা পেতে গবেষণার কাজে ভুক্তভোগী রোগীদের; যারা পরবর্তীতে মারা গেছেন তাদের ব্রেইন টিস্যু প্রয়োজন। কিন্তু মহামারীর প্রথমদিকে বিজ্ঞানীরা তা খুঁজে পাননি।
সংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করায় বেশিরভাগ সময়েই রোগীদের ময়নাতদন্ত করা হয়না। গবেষণার কাজে প্রয়োজনীয় গবেষণা সরঞ্জামাদিরও অভাব ছিল।
তবে এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ব্রেইন টিস্যু নিয়ে গবেষণা করেছেন ড. অভিন্দ্র ও তার দল।
দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে তাদের প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড-১৯ এর প্রভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও প্রদাহের প্রমাণ মিলেছে।
মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাব্য কারণও খুঁজে পেয়েছেন তারা। আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের অতি ক্ষুদ্র রক্তনালীতে ফুটো লক্ষ করেন গবেষকরা।
এধরনের আঘাতের সাথে স্ট্রোকের কারণে মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রকৃতির মিল রয়েছে। হৃদকম্পন, শ্বাস-প্রশ্বাস ও রক্তচাপ সহ রোগীদের বিভিন্ন উপসর্গের কারণ সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছে এ গবেষণা।
"বুক ধড়ফড় করা এবং সে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে গেলে মাথা ঝিমঝিম করার মতো সমস্যার কথা জানিয়েছেন অনেক রোগী। অনেকের মূত্র সংক্রান্ত জটিলতাও দেখা যেতে পারে।"
অনেকেই মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণেই তীব্র অবসাদ ও ক্লান্তি অনুভব করেন। এসব উপসর্গের জন্য দায়ী মস্তিষ্কের প্রদাহ ও রক্তনালির ফুটোর কারণে মস্তিষ্কের অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কাও থাকে।
আলঝেইমারস অ্যাসোসিয়েশনের মেডিক্যাল অ্যান্ড সায়েন্টিফিক অপারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হেথার স্নাইডার জানান, আলঝেইমারের ক্ষেত্রেও এ সমস্যাগুলো দায়ী, এবং কোভিড-১৯ এর কারণেও এসব জটিলতা দেখা যাচ্ছে।
আলঝেইমারস অ্যাসোসিয়েশন এবং ৩০টি দেশের বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কে কোভিড-১৯ এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে গবেষণার কাজে নতুন একটি সংস্থার কার্যক্রম শুরু করেছেন। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী এবং ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ আন্তর্জাতিক গবেষণার কাজে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের গবেষণার কাজে নিয়োগ দেয়া হবে।
ড. স্নাইডার জানান, রোগীদের ওপর কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার বিভিন্ন প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দিবে এ গবেষণা। এ গবেষণায় গবেষকরা ছয় মাস সময়ের ব্যবধানে রোগীদের স্মৃতিশক্তি, আচরণ ও সার্বিক কার্যক্রমের পরিবর্তন মূল্যায়ন করবেন।
- সূত্র: এনপিআর