গভীর বনের লজ্জাবতী বানরের ভবিষ্যৎ কী?
গাছের মগ ডাল পা দিয়ে আকড়ে ধরে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে বেশির ভাগ সময়। আর থাকে ঘন চির সবুজ বনে, চলাচল করে খুব ধীরে। দিনের বেলায় বের হয় না, নববধুর মত নিজেকে আড়ালে রাখতেই পছন্দ। যত্রতত্র ঘোরাঘুরি একদম না, নিজের এলাকায় ছেড়ে যেতে খুবই অনীহা। এর কারণেই বোধহয় এদের নাম হয়েছে লজ্জাবতী বানর।
প্রাণীকুলের সুন্দর প্রাণীদের অন্যতম এই লজ্জাবতী বানর, যাদের আরেক নাম বেঙ্গল স্লো লরিস।
আর বাংলাদেশে প্রথম বারের মত লজ্জাবতী বানরের উপর মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘ মেয়াদি গবেষণা শেষ হয়েছে। তবে এই শেষ নয় বাংলাদেলে প্রায় অজানা এই লজ্জাবতী বানরকে জানার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে সিদ্ধান্ত গবেষক দলটির।
২০১৭ সালে থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২ বছর মেয়াদী তাদের এই গবেষণার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। কিছু অংশ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
লজ্জাবতী বানরের গবেষক হাসান আল-রাজীর নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জের সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা ও মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া ও আদমপুর বনে এই গবেষনা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই গবেষণা কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন করেন সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবির বিন মুজাফফর।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই এই গবেষণা কার্যক্রমে দীর্ঘ দুই বছরে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ২৩ টি, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ৩৩টি, রেমা –কালেঙ্গা বনে ৮টি এবং আদমপুরে ৪টি লজ্জাবতি বানরের সাথে সরাসরি দেখা হয় গবেষকদের।
পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক গবেষণা কাজের জন্য বনের ভেতর নতুন ট্রেইল নির্মাণ প্রয়োজন হলেও নতুন ট্রেইল শুধুমাত্র গবেষণার জন্য নির্মানের পক্ষে না বাংলাদেশের বন বিভাগ। ফলে গবেষক দলকে বিদ্যমান পুরনো ট্রেইল ধরে রাতের বেলায় এই জরিপের কাজ পরিচালনা করতে হয়েছে।
নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও বাংলাদেশে প্রথম বারের মত প্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে আসা এই লজ্জাবতি বানর নিয়ে গবেষণা করতে পারায় তৃপ্ত গবেষক দল। এই গবেষণা লজ্জাবতি বানর সংরক্ষণে বড় ভুমিকা রাখবে বলে মনে করছেন তারা।
গবেষক দলের প্রধান হাসান আল-রাজী জানান, 'আমরা কোন নতুন ট্রেইল নির্মাণ করতে পারিনি পুরানো যে ট্রেইল ছিল তা ধরেই জরিপ করেছি এবং যেহেতু এই বানর রাতের বেলা সক্রিয় থাকে তাই রাতেই পুরো গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে প্রতি কিলোমিটারে ১ দশমিক ৭৮টি, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রতি কিলোমিটারে ০.৮২ টি, রেমা-কালেঙ্গা বনে প্রতি কিলোমিটারে ০.৩৬ টি ও আদমপুরে প্রতি কিলোমিটারে ০.১৩ টি লজ্জাবতী বানর পাওয়া গেছে। তবে সাতছড়ি বনের ক্ষেত্রে ডিসটেন্স স্যামপ্লিং ম্যাথড ব্যবহার করে পুরো বনের লজ্জাবতী বানরের একটি সম্ভাব্য সংখ্যা হিসেব করা হয়েছে। এই হিসেব অনুযায়ী সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ৩০ থেকে ৩৮ টি লজ্জাবতি বানরের অস্তিত্ব আছে।
অন্যদিকে অন্যান্য বনগুলোতে ডিসটেন্স স্যামপ্লিং ম্যাথড ব্যবহার করতে না পারায় ওই বনগুলোতে লজ্জাবতী বানরের সংখ্যা নিয়ে কোন ধারণা করা সম্ভব হয় নি। লজ্জাবতী বানর নিশাচর এবং বৃক্ষবাসী প্রাণী। খুব বিপদে না পড়লে এরা গাছ থেকে মাটিতে নামে না। তাই এদের সংরক্ষণ করতে চাইলে বনে গাছপালা বাড়াতে হবে, যাতে করে নিরবচ্ছিন্ন আচ্ছাদন থাকে। কিন্তু বন উজাড় হয়ে এদের বাসস্থান হুমকির মুখে।
গবেষক দল জানায়, লজ্জাবতী বানর একটি নিশাচর প্রাণী। এর আগে তারা দীর্ঘ ১৭ মাস সাতছড়ি বনে ৬টি লজ্জাবতী বানরের গতিবিধি নিয়ে কাজ করেছেন, যার মধ্যে চারটি পুরুষ এবং ২ টি মহিলা ছিল।
হাসান আল-রাজী বলেন, "আমাদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে সন্ধ্যার পরপরই এই বানর সক্রিয় হয়ে ওঠে। রাতের সক্রিয় সময়ের মাঝখানে বড় একটা সময় এরা ব্যয় করে ঘুরে বেড়ানোয়। খাবার সংগ্রহ ও খাওয়া এবং বিশ্রামের জন্য, এরা প্রায় একই সমান সময় ব্যয় করে। গবেষণায় দেখা গেছে মহিলা লজ্জাবতী বানর পুরুষের তুলনায় বেশি ঘুমায় এবং বিশ্রামও নেয় বেশি সময়। আর শীতকালে এলে গ্রীষ্মকাল থেকে আরও শ্লথগতির হয়ে যায় লজ্জাবতী বানর। অন্য সময়ের চেয়ে চলাফেরা অনেক কমিয়ে দেয়। আর রাতে সক্রিয় থাকাকালীন প্রাকৃতিক বনেই বেশি থাকে। তবে খাবারের খোঁজে এরা লেবু বাগানে আসে, আর আসে জিকা গাছ থাকে যেসব অংশে সেখানে। জিকা গাছের গা বেয়ে জেলির মত দেখতে আঠা গড়িয়ে নামে, এই আঠা লজ্জাবতী বানরের প্রিয় খাবার।
লজ্জাবতী বানরের গবেষক দলের এই গবেষণার পর্যবেক্ষণ ছিল, লজ্জাবতী বানরের আচার আচরণ বা অভ্যাস সম্বন্ধে জানা। এবং আচরণ বা অভ্যাসের বিবরণ সম্বলিত অংশটি বিখ্যাত Cambridge University Press থেকে "Evolution, Ecology and Conservation of Lorises and Pottos" নামক বইয়ের একটি অধ্যায় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
যেহেতু এরা প্রাকৃতিক বনে বেশি থাকে আর আঠা এদের প্রধান খাবার, তাই এদের টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাকৃতিক বন রক্ষার পাশাপাশি আঠা উৎপাদনকারী গাছ যেমন- জিকা, বহেরা, রঙ্গি ইত্যাদি গাছ বনে আছে কিনা সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।
তবে লজ্জাবতী বানরের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে তাদের গবেষণায়। এই সব বনগুলোতে লজ্জাবতী বানরের প্রধান হুমকি হলো বনের মাঝের সড়ক এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের তার। এর আগেও বনের ভিতরে থাকা রাস্তায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের তারে তড়িতায়িত হয়ে লজ্জাবতী বানরের প্রাণ হারানোর ঘটনার কথা শোনা গেছে। গবেষক দলের প্রধান হাসান আল-রাজী নিজেই বনভূমিতে নেমে আসতে দেখেছেন লজ্জাবতী বানরকে, যা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। তিনি এই বানরকে ঢাকা- সিলেট হাইওয়ে পার হতেও দেখেছেন এর আগে।
বাংলাদেশ বন্যপ্রানী সেবা ফাউন্ডেশ (শ্রীমঙ্গল) পরিচালক সজল দেব জানান, চলতি বছরে বিদ্যুতে পুড়ে যাওয়া ২টি এবং খাবারের সন্ধানে বনের বাইরে চলে আসা দুইটি আহত বানরকে উদ্ধ্বার করে তারা সুস্থ করে তুলেছেন।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন বলেন চলতি বছরে শ্রীমঙ্গলের আশেপাশের এলাকা থেকে বেশ কিছু আহত লজ্জাবতি বানর উদ্ধার করা হয়েছে যারা সড়ক ও বিদ্যুতের তারের কারণে আহত হয়েছিল। মোট কয়টি বানার এরকম দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হয়েছে তা নথিতে লিপিবিদ্ধ করা আছে বলে জানান তিনি।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ) রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, 'যেকোন বনের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ আমরা দিতে চাইনা। অনেক সময় জাতীয় স্বার্থে দিতে হয়। এই সব ক্ষেত্রে অবশ্যই রাবার দিয়ে তার মুড়ে দিতে হয়। বানর জাতীয় প্রানীর জন্য উন্মুক্ত তার সব চেয়ে বেশি বিপদজনক। আমরা এ নিয়ে কথা বলেছি বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে। দ্রুত এই তারগুলো রাবার দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে ।