গরু বিক্রি থেকে সফলতার চূড়ায় হুন্দাই প্রতিষ্ঠাতার অবিশ্বাস্য পথচলার কাহিনী
শিগগির বাংলাদেশে কার উৎপাদন শুরু করবে হুন্দাই মোটরস। গণমাধ্যমের সুবাদে সংবাদটি এখন হয়তো আমরা সকলেই জানি। কিন্তু, দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রসিদ্ধ কার উৎপাদক কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সুপরিচিত অটোমোবাইল ব্র্যান্ডে পরিণত হলো সেই কাহিনী তুলে ধরতেই এ আয়োজন। অনেক সময় বাস্তব জীবন হার মানায় রূপকথাকে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনুপ্রেরণায় ভরা সেই ইতিহাস সকলকেই উজ্জীবিত করার ক্ষমতা রাখে।
১৯৬৭ সালে হুন্দাই মোটর কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন উদ্যোক্তা চুং ইয়ু-ট্যাং। আর আজ কয়েক দশকের পথ-পরিক্রমায় দ. কোরিয়ার উলসানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইন্টিগ্রেটেড অটোমোবাইল উৎপাদক কারাখানা রয়েছে কোম্পানিটির। কারখানার বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১৬ লাখ ইউনিট। কর্মরত আছেন ৭৫ হাজার ব্যক্তি। ২০১৯ সালে কোম্পানিটি আয় করে মোট ৯ হাজার! কোটি ডলার।
কিন্তু, শুধু গাড়ি নয়, অবকাঠামো নির্মাণ, ইলেকট্রনিক্স পণ্য এমনকি খোদ প্রতিরক্ষা সামগ্রীর বড় উৎপাদক আজ হুন্দাই ইন্ডাস্ট্রিজ।
গরু বিক্রি থেকে কার উৎপাদকে পরিণত হওয়ার সেই রুদ্ধশ্বাস গল্প:
কৃষকের ছেলে যিনি ব্যবসার জন্য বাবার গরু চুরি করে বিক্রি করেছিলেন:
চুং ইয়ু-ট্যাং (১৯১৫-২০০১) বর্তমান কালের উত্তর কোরিয়ার অন্তর্গত তংচোন অঞ্চলে একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন। বড় সন্তান হওয়ায় তিনি পারিবারিক খামারের দায়িত্ব একদিন নিজের কাঁধে তুলে নেবেন, এমন আশাই করতেন তার পিতা।
পারিবারিক খামারে বেশিরভাগ সময় শ্রম দেওয়ার পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করতে সক্ষম হন চুং। কিন্তু, নিজেদের আর্থিক দশা আর জীবনযাপনের মান নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই সেই দারিদ্র্যপূর্ণ গ্রামীণ জীবন থেকে পালানোর ফন্দি কষতে থাকেন মনে মনে।
১৬ বছর বয়সে তিনি প্রথম তংচোন থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। চুং এবং তার এক বন্ধু সেই উদ্দেশ্যে নিজেদের কিছু মালামাল গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে রওনা দেন । পিচন উপত্যকার দুর্গম ও বিপজ্জনক ১৫ কি.মি পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে কাজের সন্ধানে উ. কোরিয়ার কোউন অঞ্চলে যান তারা। সেখানে একটি অবকাঠামো নির্মাণের কাজে দুই বন্ধু শ্রমিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। কিন্তু, খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে চুং এর পিতা তার হদিশ পান এবং অবিলম্বে বাড়ি ফেরার আদেশ দেন।
চুং অবশ্য তাতে হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। প্রথমবার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা সবাই একটু ভুলে যেতেই তিনি আরেকবার চেষ্টা করলেন। এবার গন্তব্য ঠিক হলো আজকের দিনের দ. কোরিয়ার রাজধানী সিউল শহর। পথের খরচা যোগাতে গোপনে বেঁচে দিলেন পারিবারিক খামারের গরুগুলো, সেই টাকায় কিনলেন সিউলে যাওয়ার ট্রেনের টিকিট। গোপন অভিযানটি এবারও প্রথমে সফল হয়েছিল। কিন্তু, মাস দুয়েক পর আবার তার খোঁজ বের করলেন পিতা। এবারও তাকে তংচোনে ফিরিয়ে নিয়ে আসলেন।
চালের ব্যবসা করে উত্থান শুরু:
চুং- এর উচ্চাশা যত সহজে ভেঙ্গে দেওয়া সম্ভব হবে বলে তার পরিবার ভেবেছিল, ব্যাপারটা ততো সহজ ছিল না। ১৮ বছর বয়সে শেষবার পালান তিনি। এবার রাতের অন্ধকারে ফের সিউলের পথে পা বাড়ালেন। সিউলে এসে টিকে থাকার জন্য যে কাজ পেতেন, সেটাই করতে লাগলেন।
এভাবে নানা ধরনের কাজ করতে করতে একবার পেলেন একটি চালের দোকানের ডেলিভ্যারি ম্যানের চাকরি। নিজ যোগ্যতায় খুব শিগগির নিজেকে দোকানের একজন আবশ্যক কর্মীতে পরিণত করেন। তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হন দোকান মালিক। নিয়োগের ছয় মাসের মধ্যে তাই পদোন্নতি দিয়ে চুং'কে দিলেন হিসাবপত্র দেখাশোনার দায়িত্ব।
এসময় ব্যবস্থাপক হিসাবে নিজ গুনের পরিচয় দিয়ে চুং অচিরেই গড়পড়তা ব্যবসাটিকে দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধ করে তোলেন। আর মালিকের মৃত্যুর পর তিনিই পান দোকানের সত্ত্ব। এটাই ছিল তার প্রথম ব্যবসার মালিক হয়ে ওঠার ঘটনা, কিন্তু সেটা ছিল তার অগ্রযাত্রার শুরুমাত্র।
পূর্বনাম বদলে দোকানের নতুন নাম রাখেন কিউংগিল রাইস শপ এবং সেখান থেকে ভালো আয় হতে থাকে তার। কোরিয় উপদ্বীপে জাপানি দখলদারিত্ব চলাকালে তার ব্যবসা উপনিবেশবাদী রাজনীতির কবলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়।
পথচলা বন্ধুর যত, প্রত্যয় ততো দৃঢ়:
বাধ্য হয়ে আবার গ্রামে ফিরে আসেন চুং। সেখানেই কৃষিকাজে কাটে কয়েকটি বছর। কিন্তু, কৃষকের পেশা চিরতরে গ্রহণ করার ইচ্ছে তার ছিল না। আবার এক পরিকল্পনা করে পঞ্চমবারের মতো গ্রাম থেকে পালালেন। ফিরলেন সেই সিউলেই।
কিছুদিন ভাবনাচিন্তার পর খুললেন গাড়ি মেরামতের একটি গ্যারেজ। উদ্যোগটি সফলতা পায় এবং খুব শিগগির ২০ জন থেকে তার অধীনস্ত কর্মচারির সংখ্যা ৭০ জনে উন্নীত হয়।
তবে, ১৯৪৩ সালে জাপানি দখলদার সরকার গ্যারেজটি দখল করে একটি ইস্পাত কারখানার অংশে রূপ দেয়। আরও একবার স্বপ্নহারা চুং ট্রেনে করে পাড়ি জমান গ্রামের দিকে।
হুন্দাই এর প্রতিষ্ঠা:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে জাপানি দখলদারিত্ব থেকে স্বাধীনতা পায় কোরিয়া। যুদ্ধ-পরবর্তী কোরিয়ার পুনর্গঠনে নেওয়া হয় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি। সেখানেই নতুন সম্ভাবনার আলো দেখলেন চুং। ফলে আবারও খামার ছেড়ে আসলেন সিউলে এবং হুন্দাই নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন।
কোরিয়ায় পরমাণু চুল্লি এবং রেলওয়ে নির্মাণে একাধিক ঠিকাদারি এবার পেলেন তিনি। একাজে তার সাহায্যে এসেছিলেন তার আপন ছোট ভাই। ইংরেজি ভাষায় নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি বড় ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর কিছু কার্যাদেশ পাইয়ে দেন। এর ফলে আরও ফুলেফেঁপে ওঠে চুং- এর প্রতিষ্ঠানটি।
তারপর আর ফিরে দেখতে হয়নি। হুন্দাই দিনদিনে আকার নেয় দ. কোরিয়ার সবচেয়ে সফল আর সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক শিল্পগোষ্ঠীতে। অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কিয়া মোটরস- এর ৩২.৮ শতাংশ অংশীদারিত্ব, বিলাসবহুল গাড়ি উৎপাদনে নিয়োজিত জেনেসিস মোটর-এর শতভাগ মালিকানা এবং বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত গাড়ি উৎপাদন উদ্যোগ ইওনিক নিয়ে গঠিত হুন্দাই মোটর গ্রুপ।
কোরিয়ান ভাষায় 'হুন্দাই' শব্দের অর্থ 'আধুনিকতা' বা 'প্রগতি'। 'নিউ থিংকিং, নিউ পসিবিলিটিজ' বা 'নতুন চিন্তা, নতুন সম্ভাবনা' শীর্ষক ব্র্যান্ড স্লোগানের সাথেও তা একেবারে সঙ্গতিপূর্ণ।
গরু দিয়ে ঋণ শোধ:
১৯৯৮ সালে চুং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝের ডিমিলিটারাইজড জোন ৫শ' গরু নিয়ে পাড়ি দেন। বাবার কাছ থেকে যতো গরু চুরি করেছিলেন, সেগুলো ছিল তারই প্রায়শ্চিত্ত।
চুং এসময় আশা করেন, গবাদি পশুগুলো উ. কোরিয়ার দারিদ্র্যপীরিত পরিবারগুলোকে সাহায্য করবে এবং দুই কোরিয়ার একত্রীকরণে একটি সৌহার্দ্যের নিদর্শন হয়ে থাকবে।