গুগল ম্যাপে বাড়ি খুঁজে ১২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিলেন দুই যুবক
অনাহারের বিপদ তখন ঘাড়ের ওপরে নিঃশ্বাস ফেলছে। তাই করোনামহামারি রোধে দেশব্যাপী লকডাউন চললেও বাড়ি ফেরা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই যুবকের।
সঙ্গী দুটি সাইকেল আর মুঠোফোনের গুগল ম্যাপ। তা দেখেই লকডাউনের মাঝে ফিরতে হবে বাড়ি।
তারপর টানা ১২ দিন কেটেছে সাইকেলে। পেরিয়ে এসেছেন একের পরে এক জনপদ। পথে বিপদ এসেছিল। তবে থমকে যাননি তাঁরা। অবশেষে বাড়ি ফিরে এখন তাঁরা রয়েছেন হোম- কোয়ারন্টিনে। আর দীর্ঘ পথ এভাবে পাড়ি দেওয়ায় বিরল কিছু অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেন তারা।
বিশ্বজিৎ পাল এবং অচিন্ত্য পাল নামে ওই দুই বন্ধুর বাড়ি, পশ্চিমবঙ্গের ইন্দাস থানার আমরুল পঞ্চায়েতের পাটরাই গ্রামে।
গত জানুয়ারিতে একটি ঠিকাদারি সংস্থার মাধ্যমে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের একটি মেসে রাঁধুনির কাজে যোগ দেন আমরুল পঞ্চায়েতের পাটরাই গ্রামের ওই দুই বন্ধু। কাজে যোগ দেওয়ার পর এক মাসের বেতন পেয়েছিলেন। এরপর মার্চ মাসেই ভারতজুড়ে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ক্রমশ তীব্র হতে থাকে। সহকর্মীরা একে একে ফিরে যান বাড়িতে। আটকা পড়েন দুই বন্ধু।
বিশ্বজিৎ বলেন, 'এক মাস বেতন পেয়েছিলাম। ঠিকাদারকে বার বার ফোন করেও যোগাযোগ করা যায়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার টাকা ফুরিয়ে আসছিল। তখনই সিদ্ধান্ত নিই। সাইকেল চালিয়েই বাড়ি ফিরব। আমাদের পকেটে তখন সবমিলিয়ে মাত্র ৫০০ টাকা।'
এই যখন পরিস্থিতি তখন আসন্ন অনাহারের শঙ্কা থেকেই বাড়ির পথ ধরেন দুই বন্ধু। তখন রীতিমতো ত্রাস ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। লকডাউনেও আরও কড়াকড়ি এনেছে প্রশাসন।
এসবের মধ্যেই গত ১৩ এপ্রিল গাজিয়াবাদ থেকে রওনা দিয়েছিলেন দুই বন্ধু। বাড়ি পৌঁছন ২৪ এপ্রিল। গতকাল রোববার মুঠোফোনে ১২০০ কিলোমিটার যাত্রাপথের অভিজ্ঞতার কথা দৈনিক আনন্দবাজারকে শুনিয়েছেন দুই তরুণ।
অচিন্ত্য পাল বলেন, 'কাজে যোগ দেওয়ার পরেই আমরা সাইকেল কিনেছিলাম, সেই সাইকেলই ছিল একমাত্র বাহন। পাড়ি দিতে হবে নানা এলাকার অজানা সব পথ। মোবাইলে গুগল ম্যাপ খুঁজে-খুঁজে পথের দিক ঠিক করি। কতদিন যে নতুন এলাকায় ঢুকে কুকুরের তাড়া খেয়েছি তা গুনে শেষ করতে পারব না।
দুই বন্ধু বাড়ির উদ্দেশে দিয়েছিলাম ১৩ এপ্রিল রাতে। অচিন্ত্যর কথায়, 'কিছুটা যাওয়ার পরেই তাড়া করেছিল এক দল কুকুর। একটি মন্দির খোলা দেখে সেখানে ঢুকে পড়ি। সে রাত্রে খাবার জোটেনি।' ভোরের আলো ফুটতেই ফের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
বিশ্বজিতের বলেন, 'ঠিক করেছিলাম, দিনের বেলা যতটা বেশি পথ যাওয়া যায়, তা যাব। সন্ধ্যা নামলে হাইওয়ে ধরে সাইকেল চালানো নিরাপদ হবে না। মাঝে মধ্যেই সাইকেলের চাকা ফেটেছে। কখনও টিউব 'লিক' হয়েছে। কখনও আবার ১৫-১৬ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে সাইকেল সারানোর দোকান খুঁজে পেতে। লিক সারাতে কখনও লেগেছে ১৫০ টাকা। তবে বিহারে ঢোকার পরে কেউ কেউ আমাদের অবস্থা দেখে বিনা পয়সায় 'লিক' সারিয়ে দিয়েছিলেন।'
'সাইকেল সারাতেই অনেক টাকা গিয়েছে। যেহেতু সাইকেলটাই একমাত্র সঙ্গী, তাই ওকে ঠিক রাখা সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল। অনেক দিন অভুক্ত থেকেছি। যখন পারিনি, তখন এর-ওর দরজার কড়া নেড়েছি। কেউ যত্ন করে খাইয়েছেন। কেউ আবার তাড়িয়ে দিয়েছে' বলছিলেন বিশ্বজিৎ।
রাতে অজানা লোক দেখে তাঁদের অনেক জায়গা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তখন লুকিয়ে স্কুলে আশ্রয় নিতে হয়েছিল দুই বন্ধুকে। পকেটে যে টাকা ছিল, তাও শেষ হয়ে যায় বিহারে ঢোকার পরে। দুপুর হলে পথের ধারে কোনও হোটেলে খাবার চাইতেন তাঁরা। কখনোবা গ্রামে ঢুকতেন খাবারের সন্ধানে।
অচিন্ত্যর কথায়, 'সকলেই যে খাবার দিতেন তা নয়। অনেকেই তাড়িয়ে দিয়েছেন। ঝাড়খণ্ডে ঢোকার পরে চিত্রটা অনেকটাই বদলে যায়। যাঁদের কাছে খাবার চেয়েছি, তাঁরাই দিয়েছেন। গোটা যাত্রাপথে বেশ কয়েক বার পুলিশ আটকেছিল। কিন্তু আমাদের কথা শুনে তাঁরা ছেড়ে দেন।'
অচিন্ত্য বলেন, 'একদিন শরীরে এমন ব্যথা হয়েছিল যে, মনে হয়েছিল, আর বোধ হয় বাড়ি ফিরতে পারব না। কিন্তু মনে জেদ ছিল। সব সয়ে গিয়েছিল। ২৪ এপ্রিল বাড়ি ফিরে মনে হয়েছিল যুদ্ধে জিতলাম। গোটা রাস্তায় দেখেছি, কত মানুষ কত রকম ভাবে লড়ছেন এই পরিস্থিতিতে।'
গ্রামে পৌঁছনোর পরে দুই তরুণের প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। পরে তাঁদের গৃহ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইন্দাস থানার এক আধিকারিক বিদ্যুৎ পাল। এখন তাঁরা সম্পূর্ণ সুস্থ।