ছিলাম কাজপাগল ও একাকী, তারপর নিজের সঙ্গকে ভালোবাসতে শিখলাম
আমি আমার জীবনে বেশ কিছু একাকীত্বের কাল পার করেছি। কিন্তু কোনোটির তীব্রতাই আমার দ্বিতীয় বিবাহবিচ্ছেদ পরবর্তী সময়ের মতো ছিল না। আমি প্রায় এক দশকের মতো সিঙ্গেল ছিলাম। খুব ব্যস্ততার মাঝে, টিভিতে দারুণ একটা কাজ থাকার পরও, আমি ছিলাম অতিমাত্রায় একাকী।
দ্বিতীয়বারের মতো বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে আমি আমার ঐতিহ্যগত ব্রিটিশ পাকিস্তানি সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্য ধারা থেকে বেরিয়ে আসি। আমি কাউকে আমার অতীত সম্পর্কে জানাতে চাইতাম না। কেন একাধিকবার বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সে প্রশ্নের উত্তর কাউকে দিতে চাইতাম না। আমার সংস্কৃতি ও ধর্ম এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাকে কতটা প্রভাবিত করেছে, তা-ও বলতে চাইতাম না। এর কারণ, আমি নিজেই এসব প্রসঙ্গে নিজের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
এখন আমি জানি যে নিজের নিয়তি এবং একটি অসুখী বিয়েকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর মাধ্যমে আমি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা একটি বিভীষিকার শেকল ভেঙ্গে দিচ্ছিলাম। কিন্তু এ কাজ করতে কিছু মূল্য তো আমাকে চোকাতেই হতো। তবে তখন আমি শুধু একাকীই অনুভব করে যাচ্ছিলাম।
আমি আমার নিজের মতো বাঁচতাম। এমন সব শিফটে কাজ করতাম, যাতে করে হয় আমাকে ভোর চারটা অবধি জেগে থাকতে হতো, অথবা ব্রেকফাস্ট নিউজ বুলেটিনের জন্য ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ আমার ডেস্কে উপস্থিত হতে হতো। এছাড়া রাত ১১টায় শেষ হতো, এমন দেরির শিফটেও আমি কাজ করতাম।
যারা আমাকে তখন পর্দায় দেখত, তাদের কোনো ধারণাই ছিল না আমি ভিতরে ভিতরে কী অনুভব করছি। আমি ছিলাম সুসজ্জিত, কমবয়সী ও আকর্ষণীয়া – আমি কীভাবে একাকী হতে পারি?
একবার আমি বলিউড অভিনেত্রী শিল্পা শেঠীর জন্মদিনের অনুষ্ঠান কভার করেছিলাম। সেদিন যারা আমাকে টিভি পর্দায় দেখেছিল, তারা হয়তো ভেবেছিল আমি রাতভর খুব পার্টি করেছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রেকর্ডিং শেষ হওয়া মাত্রই আমি গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরে এসেছিলাম এবং শুতে গিয়েছিলাম।
এর কারণ, আমাদের আশেপাশে কত মানুষ রয়েছে, কিংবা বিশ্ব আমাদের কতটা সফল ভাবল, তার সঙ্গে একাকীত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি মানসিক অবস্থা, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের কিছু জিনিসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। আবার কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণের অধীন জিনিসও এখানে ভূমিকা রাখে।
পরিসর ও সময়ের শূন্য বাঁধন ছিল দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক। তাই সেগুলোকে দূর করতে আমি বিভিন্ন পরিকল্পনা করে রাখতাম। আমি সবসময় নিশ্চিত করতাম যেন প্রতি সপ্তাহে করার মতো আমার ডায়রিতে দুটি কাজ থাকে। হতে পারে সেটি কোনো বন্ধুর সঙ্গে ডিনার, কোনো অনুষ্ঠান, কিংবা এমনকি হেয়ারকাটের মতো অতি প্রাকটিকাল ব্যাপারস্যাপার।
ওইসব পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেলে কিছুই যেত আসত না। স্রেফ আমার ডায়রিতে ওগুলোর উল্লেখ মানেই হলো, আমি কিছু একটার অপেক্ষা করতে থাকতে পারতাম। যেহেতু আমি ফরেইন ফিল্ম পছন্দ করতাম, তাই সেগুলো দেখার জন্য আমার ডিভিডি প্লেয়ারের পাশে সবসময়ই দুটি ডিস্ক তৈরি থাকত। আমার নিঃসঙ্গতা আমাকে বেশ বড় ধরনের সিনেফাইল করে তুলেছে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমার সবচেয়ে খারাপ সময়গুলোই আবার আমার জন্য সবচেয়ে প্রোডাক্টিভ সময়ে পরিণত হয়েছে। এর কারণ, যখনই আমি অনুভব করতাম যে আমার আর হারাবার কিছু নেই, তখন আমি অনেক বেশি মুক্ত বোধ করতাম এবং আমার কাজে বিভিন্ন ক্রিয়েটিভ রিস্ক নিতে পারতাম।
তাই আমি ওই একাকীত্বের সময়টাকে কাজে লাগাতাম স্ক্রিপ্ট লিখতে, কিংবা স্ক্রিনরাইটিং কোর্সে অংশগ নিতে। আমি বেশ কিছু উপন্যাসও লিখেছি, যদিও সেগুলো কখনোই দিনের আলো দেখেনি। কিন্তু তারপরও সেগুলো আমার আত্মোন্নয়নে সাহায্য করেছে, এবং বর্তমানে একজন লেখক হিসেবে ক্যারিয়ার তৈরির পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে।
আমি আমার থেরাপিস্টের কাছ থেকে শিখেছি যে আমাকে উদ্ধারের জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না, এবং এ ব্যাপারটি খুবই স্বাভাবিক।
একজন সিঙ্গেল ও কাজপাগল মানুষ হিসেবে আমি প্রায়ই ভাবতাম, আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই সেটি কারো নজরে আসতে কত সময় লাগবে। কিংবা আমি যদি কখনো সিঁড়ি থেকে পড়ে যাই বা অন্য কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হই, তাহলেও কি লোকজন সেটি জানতে পারবে?
এ ধরনের চিন্তা আমার একাকীত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই সময়গুলোতে আমি এক পাতা প্যারাসিটামলের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, সাহায্যের প্রত্যাশায় সবগুলো ওষুধ একসাথে গিলে ফেলা কত সহজ ব্যাপারই না হবে।
আমি সুইসাইডাল ছিলাম না। তারপরও ওই ক্ষুণস্থায়ী চিন্তা আমাকে ভয় পাইয়ে দিত। তাই আমি একজন থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হই। আমরা প্রতি বুধবার লাঞ্চটাইমে দেখা করতাম। ওই একটি ঘণ্টা ছিল সপ্তাহের মাঝে আমার টিকে থাকার ভিত হিসেবে, এবং আসন্ন উইকেন্ড উপলক্ষ্যেও আমাকে উদ্দীপ্ত করে তুলত।
আমি থেরাপিস্টের কাছ থেকে যা শিখি তা হলো, কেউই আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে না, এবং সেটি একদমই স্বাভাবিক। আমি মেনে নিতে শিখি, এমনকি নিজের সঙ্গকেও ভালোবাসতে শুরু করি। অন্যদের কথার সংবেদনশীল শ্রোতা হয়ে ওঠাও আমাকে মানসিকভাবে মুক্ত করে। আমাকে শোনার কেউ যেহেতু ছিল না, তাই আমি অন্যদের শুনতে শুরু করি। আমি আবিষ্কার করি, আমার চারপাশেও এমন সব নারী রয়েছে যারা একই ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
আমি এখন জানি যে আমার আসলেই একাকী থাকার প্রয়োজন ছিল। অবশেষে আমি যখন সাক্ষাৎ করি এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে যাকে পরবর্তীতে আমি বিয়ে করি, আমি জানতাম যে জীবনের কাছ থেকে আমি কী চাই। আমি এমন কারও খোঁজ করছিলাম না যে আমার 'পৃথিবী' হয়ে উঠবে বা আমার বিপদের পরিত্রাতা হবে। কারণ আমি নিজেই নিজের পৃথিবী গড়ে তুলেছিলাম এবং নিজেকে নিজেই উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাই এখন আমি শুধুই এমন কারও সন্ধানে ছিলাম, যে আমার পাশে এসে বসবে, যাতে করে আমরা দুজন একসাথে পৃথিবীটাকে দেখতে পারব। হ্যাঁ, সেরকম একজন মানুষকেই আমি পেয়েছি।
লেখক: সায়মা মীর একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ-পাকিস্তানি সাংবাদিক। তার বেড়ে ওঠা ব্র্যাডফোর্ডে। দ্য টাইমস, গার্ডিয়ান ও ইনডিপেন্ডেন্টের মতো পত্রিকায় লিখেছেন তিনি।