জাপানে চালু হচ্ছে ‘একাকীত্ব মন্ত্রণালয়’
করোনা মহামারির সময় ওয়ার্ক ফ্রম হোম ও সামাজিকভাবে মেলামেশার অভাবে মানুষ ক্রমশ মানসিক চাপ ও নিঃসঙ্গবোধ করতে শুরু করেছে। গত ১১ বছরের মধ্যে জাপানে প্রথমবারের মতো আত্মহত্যার হার বাড়ার কারণ হিসেবে মূলত মহামারি উদ্ভূত সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকেই দায়ী করা হচ্ছে।
এই গুরুতর সমস্যাকে স্বীকার করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদ সুগা শুক্রবার মানবিক বিচ্ছিন্নতা দূর করার জন্য একজন মন্ত্রী নিয়োগ ও মন্ত্রণালয় চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এই মন্ত্রীত্ব পেয়েছেন তেতসুশি সাকামোতো, তিনি একাধিক মন্ত্রণালয় ও এজেন্সির সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যকার একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রভৃতি কমানোর প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করবেন।
প্রধানমন্ত্রী সুগা একাকীত্ব বিষয়ক মন্ত্রী সাকামোতোকে জানান, 'বিশেষ করে নারীরা অধিকতর বিচ্ছিন্নতাবোধ করছে এবং তাদের আত্মহত্যার হার বাড়ছে। আমি চাই আপনি বিষয়টি নিরীক্ষা করে একটি কার্যকর পদ্ধতি অবলম্বন করুন।'
সাকামোতো ইতোমধ্যে কাজে নেমে পড়েছেন। আন্তঃএজেন্সি যোগাযোগের জন্য নিবেদিত একটি দল একত্রিত করার পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। প্রধান করণীয় চিহ্নিত করতে এই মাসের শুরুতেই অ্যাডভোকেসি গ্রুপ এবং সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি জরুরি ফোরামের আয়োজন করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর সাকামোতো সাংবাদিকদের বলেন, 'আমি এমন কার্যক্রম প্রসার করতে চাই, যা একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রতিরোধ করবে এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্ক সমুন্নত করবে।'
সাকামোতোর দায়িত্বে নতুন একাকীত্ব বিষয়ক সমস্যা মোকাবেলার বাইরে রয়েছে আঞ্চলিক জনসংখ্যা পুনর্নির্মাণ এবং জাপানের জনসংখ্যার হার পতন মোকাবেলা করা।
সাকামোতো জানান, তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আত্মহত্যা প্রতিরোধ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ফুড ব্যাংকের সমন্বয় ঘটাতে পারবেন।
তিনি বলেন, 'আমরা একটি বিস্তৃত পদ্ধতি নিয়ে কাজ করব, যেন নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।'
উন্নত বিশ্বে একাকীত্ব বিষয়ক মন্ত্রীর নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্য একাকীত্ব বিষয়ক মন্ত্রী নিযুক্ত করে। যুক্তরাজ্যে বয়স্কদের মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে একাকীত্বের সমস্যা।
অন্যদিকে জাপানে শিশু, তরুণ, নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিরাসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ একাকীত্বে ভোগে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য বিপর্যয়ের সময় প্রায়ই মানবিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। ১৯৯৫ সালের গ্রেট হানশিন ভূমিকম্প, ২০১১ সালের ফুকুশিমা ভূমিকম্প ও সুনামির পর অনেক বয়স্ক ব্যক্তির অস্থায়ী আবাসনে গিয়ে বসবাস করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এতে দেখা গেছে, যখন তারা মারা যান, তাদের দেখবার মতো সেখানে কেউ থাকে না। এই ধরনের নিঃসঙ্গ মৃত্যু, যাকে জাপানি ভাষায় কোদোকুশি বলা হয়, তা জাপানে জনগণের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগে পরিণত হয়েছে।
করোনা মহামারির কারণে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মহামারির সময়ে গোটা দেশেই নাগরিকদের বাড়িতে থাকতে এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলতে উৎসাহিত করা হয়েছে, কিন্তু বয়স্ক জাপানি- যারা অনলাইনে যোগাযোগ করতে অভ্যস্ত নন, তারা নিকটজনের কাছ থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
এমনকি প্রযুক্তিপ্রেমী তরুণ প্রজন্মও দীর্ঘ সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ফলে নিসঙ্গতায় ভুগেছে। কারণ অফিস এবং স্কুল বন্ধ থাকা মানে সহকর্মী ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যাওয়া। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, ফলে করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে যোগ হয়েছে অর্থনৈতিক চাপ।
জাপান সরকার বিশ্বাস করে, এসব চ্যালেঞ্জই আত্মহত্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। পুলিশ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০১৯ সালে ৭৫০ জনের আত্মহত্যার বিপরীতে ২০২০ সালে আত্মহত্যা করেছেন ২০ হাজার ৯১৯ জন। ২০০৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর এটাই আত্মহত্যা প্রবণতার এতটা বৃদ্ধি।
ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং বিরোধী দলের আইন প্রণেতারাও জাপানি সমাজে একাকীত্ব দূর করার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এলডিপি'র তরুণ আইন প্রণেতারা গত জানুয়ারিতে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি গবেষণা গ্রুপ চালু করেন। তারা আগামী মাসের শুরুতে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। 'কার্যকর নীতির ভিত্তি স্থাপন করতে আমরা একাকীত্বের একটি সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নিয়ে আসতে চাই, যেন কী ঘটছে তা বুঝতে পারি,' বলেন গবেষণা গ্রুপের অন্যতম গবেষক স্থপতি তাকো সুজুকি।
তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এই উপলব্ধি রয়েছে, একাকীত্বের ফলে হৃদরোগসহ আরও অসংখ্য নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যা হতে পারে মৃত্যুর কারণও।' তিনি জানান, নতুন মন্ত্রিসভার পদ তৈরি এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় জাপান সরকার যুক্তরাজ্যের মডেল অনুসরণ করতে পারে, যেখানে একাকীত্ব বিষয়ক একজন মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং ২০১৮ সালে তারা একটি 'একাকীত্ব সংক্রান্ত কৌশলপত্র' প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাজ্য সরকারি জরিপে একাকীত্বকে একটি বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তরুণ ও বেকারদের মতো আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের সাহায্য করতে স্থানীয় সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ শুরু করে। গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের জনসংখ্যার অন্তত ১৩ শতাংশ একাকীত্বে ভুগছে, এবং বিচ্ছিন্নতায় ভোগা এই জনগোষ্ঠীর জন্য ব্রিটিশ অর্থনীতিতে বছরে খরচ হতে পারে ৩২ বিলিয়ন পাউন্ড (৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
- সূত্র: নিক্কেই এশিয়া