জলবায়ু পরিবর্তনের অশনি সংকেত: অভিবাসন করছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবসত্তা প্ল্যাঙ্কটন
যুক্তরাজ্যের প্লিমাউথ উপকূলের অনতিদূরে ভাসমান একটি জাহাজের ডেকে সমুদ্র থেকে উঠানো হলো এক অদ্ভুতদর্শন বাক্স। দেখতে শিশুদের কল্পনার ভিনগ্রহবাসীর আকাশযানের মতোই।
কিন্তু সমুদ্রবিজ্ঞানী ক্লারে ওস্টেলে নিশ্চিন্তেই খুলে ফেললেন বাক্সের ডালা। ভেতরে রেশমের পাতলা জালি টেনে ধরে তাতে আটকা পড়া সবুজ রঙের জ্বলজ্বলে প্রাণির চিহ্ন খুঁজছিলেন। এই ক্ষুদ্রপ্রাণগুলো সাধারণ নয়, বরং পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীব—প্ল্যাঙ্কটন।
আর কিম্ভূত বাক্সটির নাম কন্টিনিউয়াস প্ল্যাঙ্কটন রেকর্ডার। আকারে টর্পেডোর মতো দেখতে এই যন্ত্র গত ৯০ বছর ধরে বাণিজ্যিক জাহাজ ও মাছ ধরার নৌকাগুলো মহাসমুদ্রের বিস্তৃত অনেক জলপথে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
এসব নৌযানের প্ল্যাঙ্কটন রেকর্ডার বিশ্লেষণ করে সমুদ্রের ক্ষুদে বাসিন্দাদের জীবন ও গতিবিধি সম্পর্কে আরও ভালো করে জানার সুযোগ পান বিজ্ঞানীরা।
প্ল্যাঙ্কটন কোনো নির্দিষ্ট একটা প্রাণির নাম নয়, বরং বৈচিত্র্যপূর্ণ সামুদ্রিক অণুজীবের গোত্র। আকার, ধরন ও ভেসে বেড়ানোর সময়ের ওপর নির্ভর করে বিজ্ঞানীরা প্ল্যাঙ্কটনের শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। তবে প্রধান শ্রেণি মূলত দুটি—ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন (বা উদ্ভিজ্জ প্রাণ) এবং জুপ্ল্যাঙ্কটন (ক্ষুদ্র প্রাণি, যা সামুদ্রিক মাছের প্রধান খাদ্য)।
ক্লারে ওস্টেলের মতো বিজ্ঞানীরা দেখছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে উষ্ণ হয়ে উঠছে মহাসাগর, প্রচলিত স্থান থেকে সরে যাচ্ছে প্ল্যাঙ্কটনের দল। এই ঘটনা সামুদ্রিক জীবন ও মানবসভ্যতা, উভয়ের জন্যেই মারাত্মক পরিণাম ডেকে আনবে।
প্ল্যাঙ্কটন জলজ প্রাণি, সমুদ্র স্রোতেই ভাসে তারা। সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খলের মূল ভিত্তি তাদের ওপর নির্ভর করে।
তবে একইসঙ্গে মানুষসহ স্থল ও জলভাগের সকল জীবের জীবনধারণের জন্য উপযোগী একটি জটিল চক্রের অত্যাবশ্যকীয় অংশ প্ল্যাঙ্কটন।
স্থলভাগের বনভূমির চেয়েও বেশি অক্সিজেন উৎপন্ন হয় মহাসমুদ্রে। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন কর্তৃক সৃষ্ট সেই অক্সিজেনেই নিঃশ্বাস নিই আমরা। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বৈশ্বিক কার্বনচক্রেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে প্যাসিফিক সিপিআর সার্ভের বিজ্ঞানী ওস্টেলে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, 'আমরা সমুদ্রে উষ্ণায়ন লক্ষ্য করছি।'
এই সিপিআর জরিপ সম্প্রতি পৃথিবীর দুই মেরুর দিকে প্ল্যাঙ্কটনের সরে যাওয়া বা বেশি ঘনত্বের ঘটনা তুলে ধরেছে। পরিবর্তনটি এসেছে সাম্প্রতিক কয়েক দশকেই। অর্থাৎ উষ্ণ জলরাশির তাপমাত্রা আরও বাড়ায় ধীরে ধীরে শীতপ্রধান মেরুর দিকেই বেশি জন্ম নিচ্ছে প্ল্যাঙ্কটন। তাদের ওপর নির্ভরশীল জলজ প্রাণীকুলও একইভাবে ঠাণ্ডা জলভাগে অভিবাসন করছে।
কিন্তু এতে ব্যাহত হচ্ছে সম্পূর্ণ খাদ্যশৃঙ্খল। যেমন: উষ্ণ পানির প্ল্যাঙ্কটন আকারে ছোট, সেই তুলনায় মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণির জন্য বেশি পুষ্টিকর আকারে বড় ঠাণ্ডা পানির প্ল্যাঙ্কটন। এখন উষ্ণ পানির ছোট প্ল্যাঙ্কটনের ঘনত্ব বাড়ছে শীতল পানির সাগরে। এই পরিবর্তনের কারণে বিলুপ্তির মুখে পড়ছে হিমজলের প্ল্যাঙ্কটন। ফলে তাদের ওপর নির্ভরশীল প্রজাতিগুলোকে হয় খাদ্যাভ্যাস বদলাতে হবে, আর তা না পারলে আরও ঠাণ্ডা পানির উৎসের দিকে সরে যেতে হবে।
ওস্টেলে বলেন, 'এত দ্রুত এ পরিবর্তন হয়েছে যে বাস্তুতন্ত্র সে আঘাত সামলাতে পারছে না। ফলে সমুদ্রের বিপুল মৎস্যভাণ্ডার শূন্য হওয়ার আশঙ্কা করছি।'
অথচ মানব সভ্যতার ২০ শতাংশ প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে মহাসাগর। উৎসটি মাছশূন্য হওয়ার অর্থ বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের অপুষ্টি ও জীবিকা হারানোর ঝুঁকি।
মাছ ধরার ওপর বড় মাত্রায় নির্ভরশীল কিছু দেশের অর্থনীতি এতে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়বে।
জৈবিক পাম্প:
প্ল্যাঙ্কটন শব্দটি এসেছে গ্রিক থেকে, যার অর্থ ভেসে বেড়ানো। মানব চুলের যেয়ে বহুগুণ সূক্ষ্ম সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে দীর্ঘ শুঁড় আকৃতির জেলিফিশও এই কাতারে পড়ে।
কার্বন শোষণ করে সালোকসংশ্লেষণের অক্সিজেন উৎপাদন করে যে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন। উদ্ভিদের মতো কোষযুক্ত এই প্রাণিকে সাধারণত অ্যালগি বা ভাসমান শৈবাল বলা হয়। এই শৈবালই আবার ক্রিল, মাছে পোণা, কাঁকড়াসহ অন্যান্য জলজ জীবের খাদ্য। ক্রিল একটি প্রাণীজ প্ল্যাঙ্কটন বা জুপ্ল্যাঙ্কটন।
ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন সূর্যের রশ্মিকে কাজে লাগিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড ভেঙ্গে অক্সিজেন অবমুক্ত করে। এভাবে লাখো কোটি ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন শত শত কোটি টন কার্বন শোষণ করে পৃথিবীর বাতাসকে নির্মল রাখতে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর অক্সিজেনের অর্ধেকের বেশি সাগরে উৎপাদিত হয়। এখানে সিংহভাগ ভূমিকাই রাখে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন।
বিজ্ঞানীরা একে বলছেন মহাসমুদ্রের জৈবিক কার্বন পাম্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এই পাম্পই আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে প্রতিনিয়ত যে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করছি, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শোষণ করে জীবন চক্রের মাধ্যমে সমুদ্রের গভীরে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
গাছপালা কাঠ বা পাতায় কার্বন সংরক্ষণ করলেও, ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন নিজ শরীরে জমা রাখে। যা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে অন্যান্য প্রাণির শরীরে যায়। যেমন, ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনভোজী জুপ্ল্যাঙ্কটন থেকে সেগুলো খাওয়া তিমি বা সামুদ্রিক পাখিদের দেহে সঞ্চিত হয় কার্বনভাণ্ডার।
খাদ্যচক্রের শীর্ষে থাকা প্রাণিগুলো মানুষের হাতে ধরা না পড়লে বা কোনোভাবে ডাঙায় ভেসে না এলে, তাদের মৃতদেহ কার্বনভাণ্ডার নিয়েই সমুদ্রের অতলে চলে যায়। ফলে বিপুল পরিমাণ কার্বন বাতাসে ফিরতে পারে না।
সিপিআর সার্ভের প্রধান বিজ্ঞানী ডেভিড জনস বলেন, 'জীবনচক্রের কোনো না কোনো এক সময়ে সমুদ্রের প্রায় সকল প্রাণিই প্ল্যাঙ্কটন খায়।'
বদলের বিরুপ প্রভাব:
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা প্রচণ্ড চাপে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বাড়ায় সমুদ্রের গভীর থেকে জলরাশির উপরিভাগে পুষ্টিকর খনিজ ভেসে ওঠার পরিমাণ কমেছে। অন্যদিকে, ঢেউয়ের কারণে পানিতে মেশা অত্যধিক পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড পানির অম্লকরণ বাড়িয়েছে।
জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু প্যানেল—আইপিসিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'জলবায়ু পরিবর্তনের নজিরবিহীন প্রভাব উন্মুক্ত সমুদ্র ও উপকূলীয় বাস্তুসংস্থানের ওপর পড়েছে। গত হাজার বছরেও এমন নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে সমুদ্রচারী উদ্ভিদ ও প্রাণিদের জন্য মারাত্মক পরিণতি অপেক্ষা করছে।
ওই প্রতিবেদনে 'জলজ জীবনচক্র প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত' হওয়ার আশঙ্কা করা হয়।
শুধু শীতল পানির দিকে সরে যাওয়াই নয়, তাপমাত্রা বাড়তে থাকার ফলে চলতি শতকের মধ্যেই ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হওয়ার অনুমান করছেন আইপিসিসি'র বিজ্ঞানীরা।
কার্বন নিঃসরণ মাত্রার ওপর ভিত্তি করে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের গড় বৈশ্বিক জৈব ওজন (বায়োম্যাস) বছরে ১ দশমিক ৮ থেকে ৬ শতাংশ হারে কমতে থাকবে।
কিন্তু জলজ খাদ্য চক্রের প্রাথমিক উৎস হওয়ায় এর সামান্যতম পরিমাণে কমে যাওয়াও বহুগুণে অন্যান্য প্রাণিকে প্রভাবিত করবে। ফলে সমুদ্রে মোট জীবের সংখ্যা ৫ থেকে ১৭ শতাংশ হারে কমতে থাকবে।
প্লিমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যাঙ্কটন ইকোলজিস্ট অ্যাবিগেইল ম্যাককোয়াট্টার্স গ্যালপ বলেন, 'ছোট প্ল্যাঙ্কটনের পরিমাণ বাড়ায় কার্বনচক্রও ব্যাহত হবে, কারণ তুলনামূলক ছোট প্ল্যাঙ্কটন বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে না।'
গ্লাসগোতে আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনের আগে মানুষের হাতে কীভাবে জীবন সহায়ক প্রাণচক্র হুমকির মুখে পড়েছে, তা-ই উঠে এসেছে প্ল্যাঙ্কটন অভিবাসন নিয়ে করা এ প্রতিবেদনে।
- সূত্র: এএফপি