জলবায়ু সংকট: বাংলাদেশিরা যেভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি মোকাবিলা করছেন
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আশঙ্কাজনক মাত্রায় বেড়ে চলেছে সমুদ্রের জলরাশির উচ্চতা। দেখা দিচ্ছে ঘন ঘন বন্যা ও মারাত্মক সব জলোচ্ছ্বাস। ইতোমধ্যেই যার কবলে লাখ লাখ বাংলাদেশির জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হচ্ছে। উপকূলে লোনা পানির আগ্রাসনে নতুন নতুন এলাকা চাষাবাদের উপযোগিতা হারাচ্ছে। জলাবদ্ধ ভূমি ও লবণাক্ততার কারণে শুধু উপকূল নয়, বরং সমগ্র জাতির খাদ্য ও সুপেয় পানির নিরাপত্তা আজ বিপন্ন।
গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুসারে, গত দুই দশকে বিরূপ আবহাওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে প্রতিনিয়ত আরও ধ্বংসাত্মক ও অনিশ্চিত এসব দুর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন এদেশের কৃষকরা। ভাসমান বীজতলা বা ক্ষেত থেকে শুরু করে লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান চাষে ঝুঁকছেন তাঁরা।
উপকূলীয় জেলা পিরোজপুরের মুগারঝোর গ্রামের কৃষক আলতাফ মাহমুদের ভাষায়, 'বছর ২৫ আগেও সারাবছর ধরে ফসল ফলাতাম। কিন্তু, তারপর ধীরে ধীরে সাত মাস ধরে জমিতে পানি জমে থাকা শুরু হলো। তখন জানতাম না কীভাবে বাঁচব।'
তাঁর আরেক প্রতিবেশী মোহাম্মদ মোস্তফা আল জাজিরাকে বলেন, 'এখানকার বেশিরভাগ কৃষক দরিদ্র, চাষের জমির খুব অভাব। তার ওপর সাত মাস ধরে কোন ফসল না ফলাতে পারলে যে আমাদের অনাহারে থাকতে হয়।'
তাই রাজধানী ঢাকা থেকে ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাজিরপুর উপজেলার মুগারঝোর গ্রামের কৃষকরা শতাব্দী প্রাচীন এক চাষাবাদের পদ্ধতিকে নতুন করে গ্রহণ করছেন। এই চাষ পদ্ধতিতে বীজতলা বা ক্ষেত পানির ওপরে ভাসমান থাকে।
দেশের দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে ৩০০-৪০০ বছর ধরে ভাসমান বাগানে সবজি চাষের ঐতিহ্য রয়েছে। স্থানীয় ভাষায় এ পদ্ধতির নাম ধাপ বা বায়রা। বায়রা ক্ষেতের প্লটগুলো আসলে এক রকম ভাসমান কৃত্রিম দ্বীপ। পানির স্তরের হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও ওঠানামা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরিতা মোকাবিলায় কৃষকরা নিজেদের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থার সংবেদনশীলতা অনুধাবন করেই ফিরে আসছেন ধাপ চাষাবাদে।
প্লট তৈরির জন্য প্রথমে স্থির পানির উপর কচুরিপানা বা খরের স্তূপ জড়ো করে, তা শক্ত করে বেঁধে বেঁধে তৈরি হয়- এক একটি ভাসমান ক্ষেতের অংশ। কাঠামো তৈরির পর আরও উঁচু স্তর যোগ করে, তা পিটিয়ে সমান করে ইচ্ছেমতো আকার দেওয়া হয়। তৈরি করা হয় ভেলার মতো কাঠামো। এরপর ভেলাটাকে টেনে গ্রামের প্লাবিত অংশে নিয়ে যান চাষিরা। এমন করে আরও অনেক অংশ একসাথে যোগ হয়ে গড়ে ওঠে; ছোট ছোট দ্বীপ আকারের ভাসমান সবজি ক্ষেত। এরপর সেখানে বিশেষ পদ্ধতিতে সবজির চারা রোপণ করা হয়।
ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতিও পরিবেশসম্মত, নেই রাসায়নিক সারের বালাই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্লট তৈরির সময়েই দেওয়া হয় গোবর মেশানো মাটির প্রলেপ। কাঠ বা নারকেল খোসার গুড়োও সার হিসেবে ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।
এসব উপাদানে দিয়ে এক একটি প্লট যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে রূপ নেয় একটি ভাসমান সবজি বাগান। যেখানে করলা, পুঁইশাক, ঢ্যাঁড়সের মতো অনেক সবজি উৎপন্ন করা যায়।
এটি তৈরি একটি সামাজিক উদ্যোগ, এখানে নেই লিঙ্গের ভেদাভেদ বরং নারীদের অবদানই উল্লেখযোগ্য। সারাবছর বাড়িতে প্লট তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন নারীরা, আর পুরুষরা বীজতলা তৈরি হলে তা নৌকার সাথে বেঁধে জলমগ্ন ক্ষেতে নিয়ে যান। সেখানে কোনো বাঁশের খুঁটির সাথে এরপর তা বেঁধে ফেলা হয়।
সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে সমুদ্র উষ্ণায়নের ফলে এখন ঘন ঘন বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানছে ঘূর্ণিঝড়। বেড়েছে জলোচ্ছ্বাস ও ভাঙন। খরা প্রবণতা ও অনিয়মিত বৃষ্টি কৃষিকাজ ব্যাহত করছে, জীবিকা হারিয়ে শহরের ঘিঞ্জি বস্তিমুখো হচ্ছে লাখো মানুষ।
যারা নতুন কাজের সন্ধানে যাননি, তাদের জীবিকার নতুন উপায় খুঁজতে হচ্ছে।
পানির লবণাক্ততা যেখানে বেশি, সেসব অঞ্চলের অনেক কৃষক ফসল ফলানো সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছেন। তার পরিবর্তে বেঁছে নিয়েছেন লবণাক্ত পানিতে চিংড়ি বা কাঁকড়া চাষ। সঙ্গে হাঁসও পালছেন। রাজধানী ঢাকার মতো বড় শহরে এসব কৃষিপণ্যের ভালো দাম পান পাইকাররা। কৃষকরাও পান কিছুটা।
জলবায়ু সহযোগী কৃষি গবেষণায় সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে। যেমন- লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধানসহ অন্যান্য প্রধান শস্যের জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)।
সংস্থাটির বিজ্ঞানী আলমগীর হোসেন বলেন, 'মিঠাপানির ধানের জাত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না। কারণ, লবণ ধানগাছে প্রাণশক্তি শোষণ করে।'
তিনি জানান, এজন্যই ব্রি এমন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে যা সাধারণ মাত্রার চেয়ে তিঙগুণ বেশি লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
উপকূলে লবণাক্ত পানির আগ্রাসনে বিপন্ন কৃষকরা এতে নতুন 'আশার আলো' দেখছেন বলে উল্লেখ করেন আলমগীর।
তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সাইফুল ইসলাম বলেন, বিপদের বিশালতার তুলনায় এসব উদ্যোগ সমুদ্রের এক ফোটা জলের মতোই অপর্যাপ্ত।
'পুরো উপকূল জুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণে আমাদের শত শত কোটি ডলার তহবিল দরকার। উপকূলীয় বেল্টে শ্বাসমূলীয় বাদাবন সৃষ্টি করতে হবে। এই বন সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও সমদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি মোকাবিলায় প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।'
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'উপকূলে আরও রাস্তাঘাট নির্মাণ প্রয়োজন। তৈরি করতে হবে বৃষ্টির পানি সঞ্চয়ে বড় বড় জলাধার, লাখ লাখ মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু ফসলের গবেষণায় লাভ হবে না। আর বাংলাদেশ একা এত বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নও করতে পারবে না।'
পশ্চিমা দেশগুলোই বায়ুমণ্ডলে সিংহভাগ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী, উল্লেখ করে সাইফুল বলেন, এজন্য তাদের বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, এটা সবারই জানা বাংলাদেশ ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে যে পরিমাণ জলবায়ু তহবিল পাচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা ও সহনশীলতা তৈরিতে তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যে ১০ হাজার কোটি ডলারের তহবিল দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, এপর্যন্ত তার ছিটেফোঁটা পেয়েছে বাংলাদেশ।
- সূত্র: আল জাজিরা