জলশাসনে সিদ্ধহস্ত ডাচরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় খুলে দিচ্ছে বাঁধ
নিউ মারুইদি নদীর ধারে নিজের বাগানবাড়ি ঘুরে দেখাচ্ছিলেন আন্নে লিলিভেল্ড। তার বাগানের পেছনেই বিশাল জলাশয়। চমৎকার এক জায়গা। লিলি জানান জায়গাটি তিনি ভীষণ পছন্দ করেন। কিন্তু, এই জলাশয় একইসঙ্গে তার মনকে করে তোলে বিষণ্ণ।
জলাশয়ের জায়গাটিতে একসময় লিলির প্রতিবেশীর বাড়ি ও খামার ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নদীর উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ খুলে দেয় সরকার। ফলে, জায়গাটি প্লাবিত হয়ে জলাশয়ে পরিণত হয়।
সরকারের এই প্রকল্পের নাম রুম ফর দ্য রিভারস।
নিমাঞ্চলের ভূমিকে পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে কয়েক শতাব্দী ধরে লড়াই করে আসছে নেদারল্যান্ডসের মানুষ। দেশটির এক চতুর্থাংশই সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে নিচুতে অবস্থিত।
সমুদ্র ও নদীর জল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাম, বাঁধ, স্লুইস গেট এবং বিশাল সি-ওয়ালের সাহায্যে বন্যার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করছে ডাচরা।
সবকিছুতেই ব্যতিক্রমী এক জাতি তারা। তাদের ভূমি, রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং জল-সংস্কৃতি এক কথায় অনন্য।
তবে, দীর্ঘ সময় ধরে জলরাশিকে শাসন করে ঠেকিয়ে রাখলেও জলবায়ু সংকট এই ঝুঁকিকে দিন দিন তীব্রতর করছে। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া এখন আর ভবিষ্যতের কোনো সমস্যা নয়। মানুষকে এখনও প্রতিনিয়তই আবহাওয়াজনিত বিপর্যয় মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কখনো দাবানলে পুড়ছে বন, কখনো বা আকস্মিক বন্যা সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
মানুষকে সংগঠিত করতেও ভূমিকা রাখছে এই চরম আবহাওয়া। উষ্ণতর পৃথিবী পুরো বিশ্বের জন্যই হুমকি ডেকে আনছে।
নেদারল্যান্ডসের বিশেষজ্ঞরাও বরাবরই বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। ১৭ শতকে রাজা প্রথম চার্লস ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজশায়ারে জলাভূমি নিষ্কাশনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ২০১২ সালে নিউ ইয়র্ক যখন হারিকেন স্যান্ডিতে বিধ্বস্ত, তখন যুক্তরাষ্ট্র ডাচদের কাছে সাহায্য চায়। চলতি বছর সুয়েজ খালে যখন এভার গিভেন আটকা পড়ল, তখন ডাচ একটি প্রতিষ্ঠান জাহাজ উদ্ধারে চুক্তিবদ্ধ হয়।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের মানে হলো, কয়েক শতক ধরে চলে আসা এসব পদ্ধতি যেকোনো সময় অকার্যকর হয়ে পড়বে। বাঁধ ঠিক তত বড়ই হতে পারে, যত বড় হলে নিজের ওজনে ভেঙে পড়বে না। এর উচ্চতা বাড়ানোর অর্থ ভেঙে পড়ার ঝুঁকি বাড়ানো।
১৯৯০ সালে ডাচ সরকার কৌশলগত পরিবর্তন আনতে শুরু করে। নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ একদিক থেকে ভালো বলে অনুধাবন করে তারা। নদীর পাশের জনবসতিহীন নিচু জমিগুলো প্লাবিত হলে ভারি বৃষ্টিপাতের পানিগুলো নেমে যায়।
এই ভাবনা থেকেই ডাচ সরকার নতুন এক উদ্যোগ নেয়। নিচু অঞ্চল থেকে মানুষজন সরিয়ে তারা খুলে দেয় বেশ কয়েকটি বাঁধ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফল
প্রকল্পটি গুরুত্ব বোঝার জন্য নেদারল্যান্ডসের নদীগুলোর প্রবাহ বুঝতে হবে।
লিলির বাড়ি থেকে রাইন নদীর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ওপরে অবস্থিত উপনদী আহর। নদীটি পশ্চিম জার্মান ওয়াইনের মনোরম পাহাড়ঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে।
নদীর ধারে অবস্থিত ছোট শহর দারনাউ গত জুলাইয়ে প্লাবিত হয়। শহরের বাসিন্দাদের স্মরণকালেও পানি এত উচ্চতায় উঠেনি।
২৩ বছর বয়সী লিয়া ক্রুজবার্গ ১৪ জুলাইয়ের কথা স্মরণ করে জানান, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার বাড়ির আঙিনায় পানি উঠে যায়। এরপর ক্রমশ পানি ভিতরে ঢুকে বাড়ির ভেতর পানি বাড়তে শুরু করে। সঙ্গী ও নিজের দোকানের কর্মীদের নিয়ে তিনি বাড়ির ওপরের তলায় আশ্রয় নেন।
তাদের সেই রাত কাটে ভয়াবহ আতঙ্কে। বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইলের ব্যাটারি বাঁচিয়ে রাখেন লিয়া। তার বাবা তখন ছুটিতে অস্ট্রিয়ায়। শেষ পর্যন্ত পানি সর্বোচ্চ সীমায় উঠে নামতে শুরু করে। পরদিন বিকাল পাঁচটায় তাদের উদ্ধার করা হয়।
লিয়া বলেন, "বন্যার পর বৃষ্টি হতে দেখলেই ভয় পেতাম। বৃষ্টি একটু বাড়লেই সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো মনে পড়ত, আর কান্না থামাতে পারতাম না।"
"আমরা আবার বাড়িতে থাকা শুরু করলেও এই ভয় সহজে যাবে না," বলেন তিনি।
জুলাইয়ের বন্যা ছিল ভয়াবহ। শুধুমাত্র রাইনল্যান্ড প্যালাটিনেটে ১৩৩ জন মারা যায়। জার্মানিতে সব মিলিয়ে ১৮০ জন এবং বেলজিয়ামে ৩৯ জন প্রাণ হারান। একজন ভিক্টিমের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
নেদারল্যান্ডসের জন্য ছিল সতর্কবার্তা
বাঁধ খুলে দিতে নেদারল্যান্ডসের বহু মানুষ তাদের বাড়ি ও জমি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আর এসব তারা নিজেদের জন্য নয়, অন্যদের জন্য করছেন। নদীর উপকূলে থাকা মানুষদের জীবন রক্ষার জন্য তাদের দ্বারস্থ হয়েছে সরকার।
ডাচ সরকারের অবকাঠামো ও পানি ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প ব্যবস্থাপক হানস ব্রুয়ার বলেন, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সালের ভয়াবহ বন্যা সবার জন্য সতর্কবার্তা নিয়ে আসে।
"আমরা কয়েক দশক ধরে সমুদ্রকে প্রতিরোধ করে নিজেদের রক্ষা করেছিলাম। কিন্তু এরপর আমাদের নদীগুলোই নতুন চমক নিয়ে হাজির হলো। ১৯৯৫ সালে প্রায় আড়াই লাখ মানুষকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে নদীর পানি আরও বাড়তে পারে। কিন্তু সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই পানি থেকে মুক্তি পাওয়া হবে মুশকিল।"
আজ থেকে ১৫ বছর আগে ব্রুয়ার ও তার সহকর্মীরা নল হুইজমাইজার নামের এক খামারির কাছে যান। হুইজমাইজারসহ সেখানকার আরও ১৭টি পরিবারকে জানানো হয় যে তাদের বাড়িঘর ও জায়গাজমি বন্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হবে। অর্থাৎ, যে বিশাল বাঁধের জন্য জমিটি শুষ্ক আছে, তা খুলে দেওয়া হবে।
হুইজমাইজারের বয়স এখন ৭২। পুরোনো স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, "সরকার যখন প্রথম এসেছিল, তখন ভীষণ চমকে যাই।"
সরকার বিশাল আকারের ছয় মিটার উঁচু কৃত্রিম ঢিবি তৈরি করে তার ওপর তাদের বাড়িঘর ও খামার স্থাপন করে চায়। অনেকেই বিষয়টি মেনে না নিয়ে চলে যান। তবে, হুইজমাইজার তার স্ত্রী ও অন্যান্য সাতটি পরিবার সরকারের দেওয়া স্থাপনায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। চোখের সামনে তলিয়ে যেতে দেখেন নিজেদের পুরোনো বাসভূমি।
'কষ্ট হলেও পরিবর্তন মেনে নেওয়া'
রুম ফর দ্য রিভারস নামের প্রকল্পটি শুরুতে পরীক্ষামূলক ছিল। পরবর্তীতে, ২.৬৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৩৪টি প্রকল্প হাতে নেয় নেদারল্যান্ডস সরকার। প্রকল্পগুলোর ফলাফল এখন দৃশ্যমান। ১৯৯৫ সালের তুলনায় ডাচ নদীগুলো এখন ২৫ শতাংশের বেশি পানি নিতে সক্ষম।
জুলাইয়ের তীব্র বৃষ্টিতে নদীকে ফুলেফেঁপে যেতে দেখেছেন লিলি।
তিনি বলেন, "এরপরই এই অঞ্চলের অবস্থাটা বুঝলাম। আমাদের এখানে পানি বাড়ার তেমন সমস্যা ছিল না। আমি আশা করি মানুষ বুঝবে কেন আমরা ত্যাগ করেছি।"
লিলির সাবেক প্রতিবেশীর ঘর-খামার ভাসিয়ে দেওয়া জলাশয়ে এখন বাসা বেঁধেছে অসংখ্য পাখির ঝাঁক।
"আমি সবসময় এই পরিবেশ উপভোগ করার সাহস পাই না। কারণ আমি দেখেছি এই জলভূমি মানুষের সঙ্গে কী করতে পারে," বলেন লিলি।
- সূত্র: সিএনএন