দেরি করে আহার কি সত্যিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?
স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম, কিন্তু আমরা কোন সময়ে খাচ্ছি সেটার উপরও সবল থাকা অনেকাংশে নির্ভর করতে পারে।
গত কয়েক দশক ধরেই গবেষকরা খাদ্য গ্রহণের সময়ের সাথে শারীরিক প্রভাবের কিছু ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখতে পেয়েছেন। বিশেষ করে, দেরি করে খাওয়া যাদের অভ্যাস, তাদের ক্ষেত্রেই এসমস্যা বেশি। বিশেষ করে,যারা রাত্রে অনেক দেরি করে খান তাদের জন্য মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি। একারণে নৈশকালীন কর্মীদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ বেশি থাকে।
নৈশভোজ কখন সেরে ফেলা উচিৎ অথবা রাতে কেমন খাদ্য গ্রহণ করা উচিৎ- তা নিয়ে পুষ্টি বিজ্ঞান অনেক পরামর্শই দেয়। এনিয়ে বিস্তর অনুসন্ধানও হয়েছে। তারপরও, দেরি করে খাওয়া-দাওয়া করলে কেন স্বাস্থ্যে এমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে- তার উত্তর এখনও সম্পূর্ণ জানা নেই গবেষকদের।
এব্যাপারে পাল্মোনারি রোগের চিকিৎসক জনাথন জুন জানান, ''সময়ের সঙ্গে সঠিক খাদ্য গ্রহণের কী সম্পর্ক তা জানার চেষ্টা এখনও চলছে। কেন বিষয় দুটি পরস্পর জড়িত সেই প্রক্রিয়া জানার লক্ষ্য এখনও পূরণ হয়নি।''
আপাতত অবশ্য বিজ্ঞানী ও পুষ্টিবিদেরা জনস্বাস্থ্যের প্রধান কিছু সমস্যা যেমন; ডায়াবিটিস, হৃদরোগ এবং মুটিয়ে যাওয়ার সঙ্গে গভীর রাতে খাওয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে কিনা- তা প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
সময়সূচির সংঘাত:
জৈবিক ঘড়িও দিনরাতের নির্দিষ্ট সময় মেনে চলে। এজন্য দিনের বেলায় খাদ্য হজমের অভ্যাস বেশি আমাদের। এই ঘড়িই নির্ধারণ করে কখন ঘুমানো উচিৎ আর কখন জেগে থাকব। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া তাই বিদ্রোহেরই শামিল। কারণ, ছন্দপতন দেহের জৈবিক জালের একাধিক ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায়।
যেমন; পেশিতে শক্তি সঞ্চারের জন্য প্রয়োজন হয় জিনের প্রোটিন তৈরির সাহায্য। এটি নির্ভর করে জৈবিক ঘড়ি অনুসারে। অর্থাৎ, দিনের কোনো সময় অনুসারে এটি বেশি সচল থাকে, কোনো সময় থাকে কম। জুন বলেন, ঠিক একারণেই খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাকতন্ত্রের মধ্যে একটি সময়ের সামঞ্জস্য দরকার।
দিন ও রাত ভেদে কেন শরীরের কিছু কিছু প্রক্রিয়ায় কমবেশির তারতম্য দেখা দেয় তা জানতে এখনও গবেষণা চলমান। তবে ইঁদুরের ওপর করা গবেষণার ভিত্তিতে জানা গেছে, ঘুম পর্বের সাহায্য জৈবিক ঘড়ি শরীরের কোষগুলোর ক্ষয় সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা অলাভজনক চিকিৎসা সেবা সংস্থা- মায়ো ক্লিনিকের এনডক্রিনোলজিস্ট অ্যাড্রিয়ান ভেলা ব্যাখ্যা করেন, ''ঘরদোর পরিষ্কার করতে কোষগুলোরও একটা নির্দিষ্ট সময় দরকার। একারণেই, হয়তো ঘুমানোর কিছুক্ষণ আগে দেরি করে খাওয়া হলে হজমের কাজকে কোষ প্রাধান্য দেয়। এতে তার ক্ষয় পূরণের কাজ পিছিয়ে যায়। ঘন ঘন এমন ঘটনার পুনঃরাবৃত্তি হলে তা শরীরে অনেক ক্ষতিসাধন করে।''
ব্লাড সুগারের সঙ্গে এর সম্পর্ক হচ্ছে এই তত্ত্বের আরেকটি উদাহরণ। গবেষণায় দেখা গেছে রাতে দেরি করে খাওয়া হলে রক্তে সুগারের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। নির্ধারিত সময়ে খাওয়ার অভ্যাস বদলালেও এমনটা ঘটে। খাওয়ার সময়ের ভিত্তিতে হওয়া এই তারতম্য প্রায় সকল ধরনের খাদ্যগ্রহণের ফলেই হয়।
এব্যাপারে কিছু বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যা ইঙ্গিত করে আমাদের ঘুম সহযোগী হরমোন মেলাটোনিনের দিকে। রাতেই এটির নিঃসরণ বাড়ে। মেলাটোনিন সুগারকে কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। তাই শয্যায় যাওয়ার কিছু আগে খাওয়া হলে একইসঙ্গে দুটি কাজ হয়। প্রথমত, বিছানায় শোয়ামাত্র আমাদের কোষগুলো ক্ষয় পুরণের চেষ্টা করে, আবার অন্যদিকে সুগারের বাড়তি সরবরাহ বেড়ে যায়।
ব্যাপারটা অনেকটা একইসঙ্গে গাড়ি তৈরি আর গাড়ির কারখানা তৈরির মতো সাংঘর্ষিক। হজম প্রক্রিয়ায় মেলাটোনিনের প্রভাব কতটুকু তা এখনও নিশ্চিত নয়, তবে এক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন হচ্ছে বলে জানান জুন।
- সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন