নিয়ান্ডারথালস নয়, নতুন সন্ধান পাওয়া 'ড্রাগন মানব' হতে পারে আধুনিক মানুষের নিকটাত্মীয়
চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এক কূপের তলানিতে ৮০ বছর ধরে লুকোনো মাথার খুলিটি মানব জাতির প্রথম দিককার একটি প্রজাতি বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। একে 'ড্রাগন ম্যান' নাম দিয়েছেন গবেষকরা।
নতুন সন্ধান পাওয়া ফসিল ও ফসিলটির দাঁত ও হাড়ের ডিএনএ এবং গুহার ধূলা বিশ্লেষণের পর মানবজাতির বংশানুক্রমে এলো নতুন সংযোজন।
চীনের হারবিন শহরে পাওয়া এই মাথার খুলির বয়স ১ লাখ ৩৮ হাজার- ৩ লাখ ৯ হাজার বছরের মধ্যে বলে জানা গেছে এর ভূ-রাসায়নিক বিশ্লেষণ থেকে। চওড়া নাক, তুলনামূলক নিচের দিকে অবস্থিত ভ্রু এধরণের বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যও দেখা গেছে। চোখের নিচের হাড়সহ হোমো সাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেও মিল পাওয়া যায়।
গবেষকরা বলছেন, খুঁজে পাওয়া মাথার খুলির অধিকারী ছিলেন ৫০ বছর বয়সী একজন পুরুষ। তার মুখাবয়ব অনেকটা চওড়া, চোখ সুগভীর,বড় চোখের কোটর, বড় দাঁত এবং মস্তিষ্কের আকার আধুনিক মানুষের মতোই।
গত শুক্রবার নতুন সন্ধান পাওয়া এসব বিষয় নিয়ে দ্য ইনোভেশন জার্নালে তিনটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।
লন্ডনের দ্য ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামের মানব বিবর্তন বিষয়ক প্রধান গবেষক ও এই গবেষণার সহ-লেখক ক্রিস স্ট্রিংগার বলেন, "আমার ৫০ বছরে দেখা ফসিলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ন হারবিনে খুঁজে পাওয়া এই মাথার খুলি।
গবেষকরা হোমিনিন গোত্রের নতুন এই সদস্যের বৈজ্ঞানিক নাম দিয়েছেন হোমো লঙ্গি। চীনের হেইলুংচিয়ান প্রদেশে খুলিটি খুঁজে পাওয়ায় সে অনুসারে এই নামকরণ করা হয়েছে।
খুলিটি থেকে প্রাচীন ডিএনএ সনশ্লেষণ সম্ভব কিনা তা যাচাই করছেন গবেষকরা। ডিএনএ সংশ্লেষণ সম্ভব হলেই এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা শুরু হবে। সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে সাইনাস, কান ও মস্তিষ্কের আকারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।
একই গোত্রভুক্ত আমরা
হোমো সাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষ একেবারেই আলাদা, অনন্য- এমনটা ভেবে নেওয়া খুবই সহজ। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল, যখন পৃথিবীর বুকে হোমো সাপিয়েন্স ছাড়াও মানুষের অন্যান্য প্রজাতির বাস ছিল।
প্রায় ৩ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে আফ্রিকার বুকে হোমো সাপিয়েন্সের উদ্ভবের সময় থেকেই নিয়ান্ডারথালস, ডেনিসোভানস, হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস, হোমো লুজোনেনসিস ও হোমো নালেদিসহ মানুষের অনেক প্রজাতির বাস ছিল পৃথিবীতে। এসব প্রজাতির অনেকের সঙ্গে সাপিয়েন্সরা বংশবৃদ্ধিও করেছে। এদের অনেকেরই ফসিল রেকর্ড সংরক্ষিত আছে, তবে আমাদের ডিএনও থেকেই ডেনিসোভানদের সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিনিয়তই মানব বিবর্তনের ব্যাপারে আমরা যা জানি তাতে পরিবর্তন আসছে। এটি প্যালেওঅ্যানথ্রপলজির অন্যতম চমকপ্রদ বিষয়, বলেন স্ট্রিংগার।
ইসরায়েলে সন্ধান পাওয়া ফসিল নিয়ে আরেকদল গবেষকের সায়েন্স জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার একদিন পরই 'ড্রাগন ম্যানের' সন্ধান পাওয়ার ঘোষণা আসে। ইসরায়েলে সন্ধান পাওয়া ওই ফসিলের গবেষণায়ও বলা হয়েছে, ফসিলটি আদিম মানুষের কোনো প্রজাতির হতে পারে, যার সন্ধান আগে পাওয়া যায়নি।
'লুকোনো সম্পদ'
১৯৩৩ সালে চীনের হারবিনের সংহুয়া নদীতে ব্রিজ তৈরির সময় নাম না জানা এক চীনা শ্রমিক হারবিন খুলিটি আবিষ্কার করেন বলে উল্লেখিত আছে দ্য ইনোভেশন জার্নালের এক গবেষণায়। সে সময় চীনের সেই অংশ জাপানি দখলদারত্বের অধীনে ছিল। যেই ব্যক্তি খুলিটি খুঁজে পান তিনি খুলিটি বাড়ি নিয়ে গিয়ে সুরক্ষিত রাখতে কূয়ার তলানিতে রেখে দেন।
"তার জাপানি উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে খুলিটি হস্তান্তর না করে তিনি সেটি একটি পরিত্যক্ত কূয়ায় চাপা দেন। ধন সম্পদ লুকানোর প্রথাগত চীনা উপায় এটি," বলা হয় গবেষণাটিতে।
যুদ্ধ শেষে চীনের প্রচণ্ড উত্তাল সময়ে ওই ব্যক্তি চাষাবাদের কাজে ফিরে যান, পরে আর কখনো লুকিয়ে রাখা খুলিটি উদ্ধার করেননি তিনি। জাপানি দখলদারত্ব, গৃহযুদ্ধ, সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও চীনে সাম্প্রতিক সময়ে বিপুল পরিমাণে ফসিল বাণিজ্য সৃষ্টির এতো সব বিপত্তি পেরিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল ফসিলটি। ফলে বিজ্ঞানও এর খোঁজ পায়নি।
ওই ব্যক্তির তৃতীয় প্রজন্মের সদস্যরা তার মৃত্যুর আগে তার লুকোনো এই সম্পদের কথা জানতে পারে। ২০১৮ সালে ওই কূয়া থেকে ফসিলটি উদ্ধার করা হয়। গবেষণাটির একজন গবেষক কিয়াং জি খুলিটির ব্যাপারে জানতে পারেন, তার অনুরোধে ওই পরিবারটি লুকোনো সেই খুলি হেবেই জিইও ইউনিভার্সিটির জিওসায়েন্স মিউজিয়ামে দান করে।
নিকটতম আত্মীয়
নতুন সন্ধান পাওয়া এই 'ড্রাগন ম্যান'ই বংশানুক্রমে আমাদের নিকটতম সদস্য হতে পারে। এমনকি তারা নিয়ান্ডারথালস থেকেও আমাদের আরও বেশি নিকটবর্তী প্রজাতি হতে পারে বলে উঠে এসেছে গবেষণাটিতে। তার দেহের গড়ন এবং চীনে যে অঞ্চলে সন্ধান পাওয়া গেছে, তা দেখে স্পষ্ট এই প্রজাতির রুক্ষ আবহাওয়ার সঙ্গেও খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা ছিল।
"আমাদের উৎপত্তি কোথা থেকে, কীভাবে আমাদের বিবর্তন হয়েছে এসব প্রশ্ন সবসময়ই চমকপ্রদ। আমরা আমাদের দীর্ঘদিনের হারানো নিকটাত্মীয়ের সন্ধান পেয়েছি," বলেন চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষণা অধ্যাপক ও গবেষণাটির সহ-লেখক শিজুন নি।
দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউনানের ডালি ও অন্যান্য অঞ্চলে সন্ধান পাওয়া কিছু ফসিলের শ্রেনিবিভাগ নিয়ে মুশকিলে পড়েছিলেন গবেষকরা। ওই ফসিলগুলোও হোমো লঙ্গি প্রজাতির হতে পারে গবেষণাটিতে বলা হয়েছে।
স্ট্রিংগার আরও জানান, ড্রাগন ম্যান ডেনিসোভানেরই সদস্য এমনটাও হতে পারে।
ডেনিসোভানস ও হোমো লঙ্গি উভয় প্রজাতির বড় ও একই ধরনের দাঁতের পাটি ছিল বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণায়। তবে তুলনামূলক বিশ্লেষণের জন্য খুব অল্প পরিমাণে ফসিল থাকায় এখনো নিশ্চিতভাবে তাদের একই কাতারে ফেলা যাচ্ছে না।
"আমরা এ নিয়ে সবেমাত্র বিস্তারিত গবেষণা শুরু করেছি। আগামী বেশ কিছু বছর এ নিয়ে গবেষণা চলবে," বলেন তিনি।
- সূত্র: সিএনএন