পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের নতুন রূপ!
নিউজিল্যান্ডের রোটোরুয়া অঞ্চল অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। একসময় যা পরিচিত ছিল 'পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্য' নামে। রোটোরুয়া হ্রদের স্ফটিকস্বচ্ছ পানি, হ্রদের পাশের পাহাড়—সব মিলিয়ে দেখার মতো দৃশ্যই বটে! এখানকার জলপ্রপাতগুলোর পানি ছিল উষ্ণ, মিনারেলসমৃদ্ধ। সেই জলপ্রপাতগুলো আজ না থাকলেও খনিজসমৃদ্ধ উষ্ণ পানির হ্রদ এখনও আছে।
উনিশ শতকের শেষ দিকে অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে এই প্রাকৃতিক বিস্ময়গুলোই ছিল নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। সারা বিশ্ব থেকে পয়সাওয়ালা পর্যটকরা এখানে এসে ভিড় জমাতেন টে ওটুকাপুয়ারাঙ্গি টেরেসের গোলাপি পানিতে গোসল করতে। টে টারাটা (সাদা) টেরেস দেখতে।
এখানকার জিওথার্মাল উপত্যকার পানিও স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ কারণেও বহু মানুষ আরথ্রাইটিস, বাত, একজিমা ও অন্যান্য চর্মরোগের নিরাময়ের জন্য ভিড় জমাত এখানে।
রোটুরিয়ায় যাওয়া মোটেই সহজ ছিল না। ব্রিটেন থেকে ৭৫ দিনের জাহাজভ্রমণ করে প্রথমে নিউজিল্যান্ড পৌঁছতে হতো। তারপর অকল্যান্ড থেকে বাষ্পচালিত ট্রেনে চেপে ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হতো টাউরাঙ্গাতে। সেখান থেকে ঘোড়ায় টানা ক্যারিজে চেপে রোটোরুয়া হয়ে লেক রোটোমাহানায়।
সেখানে পর্যটকদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাত রোটোরুয়ার তুহুরাঙ্গি গোত্রের নারীরা। ১৩২৫ সাল থেকে এই আগ্নেয় উপত্যকায় বসবাস করছে তারা। তারাই আশপাশের এলাকা ঘুরিয়ে দেখাত বিদেশ থেকে আসা ভ্রমণপিপাসুদের। এটাই ছিল নিউজিল্যান্ডের আন্তর্জাতিক পর্যটনের জন্মস্থান, আর এই মাওরি নারীরা ছিল দেশটির প্রথম ট্যুর গাইড।
নারী ট্যুর গাইডরা তাদের হাসিখুশি ব্যবহার, বুদ্ধিমত্তা ও উষ্ণ আতিথেয়তা দিয়ে অভ্যাগতদের মন জয় করে নেয়। সোফিয়া হিনেরাঙ্গি-গ্রে, ওরফে গাইড সোফিয়া নামে পরিচিত এক গাইড রোটোরুয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত নারী হয়ে ওঠেন। হাজারো পর্যটকের বিশ্বস্ত বন্ধু ও দার্শনিকে পরিণত হন তিনি। নিজ গোত্রের কাছে তিনি ছিলেন রোল মডেল। স্থানীয় নারীদের গাইডের কাজ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহ দিতেন তিনি। সে সময়ের গাইডরা তাদের এই অঞ্চলকে ভালোবাসতেন।
সবকিছু ভালোই চলছিল। পর্যটকদের আগমনে সর্বক্ষণই সরগরম থাকত রোটোরুয়া অঞ্চল। কিন্তু সব কোলাহল, আনন্দ-উচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে যায় ১৮৮৬ সালের ১০ জুন।
সেদিন মাউন্ট টারাওয়েরার বুকে জেগে ওঠে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। অগ্ন্যুৎপাতে কেঁপে ওঠে রোটোরুয়ার ভূমি। ১৮৪৮ সালে পর্যটকদের সেবায় পত্তন হওয়া টে ওয়াইরোয়া গ্রাম চাপা পড়ে লাভাপিণ্ড, ছাই ও কাদামাটির নিচে। সেই অগ্ন্যুৎপাতে প্রাণ হারায় দেড়শোর বেশি মানুষ। টেরেসগুলো গিলে নেয় ১০০ মিটার গভীর ক্রেটার। পরে সেই খাদ পরিণত হয় লেক রোটোমাহানায়, যা আগের হ্রদের চেয়ে ১০ গুণ বড় ও গভীর।
সেই টেরেসগুলো হারিয়ে গেলেও পর্যটকরা এখনও এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। রোটোরুয়া ও ওয়াইমাঙ্গু ভলকানিক ভ্যালির মাঝখানে অবস্থিত টে ওয়াইরোয়া, বর্তমানে যার নাম বেরিড ভিলেজ। ধীরে ধীরে ফের পর্যটকের জনসমাগম বেড়েছে এই অঞ্চলে।
প্রযুক্তির কল্যাণে পিঙ্ক ও হোয়াইট টেরেসকেও ফের জীবন্ত করে তোলা হচ্ছে। একটি অ্যাপের মাধ্যমে পর্যটকরা সেই উনিশ শতকের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারেন। ইতিহাসের হাত ধরে ঘুরে আসেন প্রায় পৌনে দুই শতাব্দী আগের রোটোরুয়া থেকে। বর্তমানের গাইডরা পর্যটকদের শেখান উত্তপ্ত বালি ও প্রাকৃতিকভাবে ফুটন্ত পানিকে কী করে রান্নার কাজে ব্যবহার করতে হয়। এখানকার নিরামকারী উষ্ণ পানি আজও পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ।
স্থানীয় গাইড ওয়ামস্লে বলেন, 'এখানকার উষ্ণ পানি এখনও রোগ নিরাময়ের কাজ করে, ত্বককে কোমল করে।' তবে এই পানিতে খুব সাবধানে গোসল করতে হয়, নইলে বিপদ হতে পারে বলে জানান তিনি।
তবে এখানকার পানিতে গোসল না করেও রোটোরিয়ার নিরাময়শক্তি অনুভব করার যায়। এখানকার নৈসর্গিক প্রকৃতির সংস্পর্শে এলেই চনমনে হয়ে ওঠে সবার দেহ-মন, নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চয় করে এখান থেকে ঘরে ফেরেন পর্যটকরা।
- সূত্র: বিবিসি