প্রকৃতি ও মানুষের সেবায় নেত্রকোনার আব্দুল হামিদ
যেকোন দুর্যোগে সবার আগে ছুটে যান তিনি। শহর-জনপদ ঘুরে হ্যান্ডমাইকে প্রচার করেন দুর্যোগের সতর্কবার্তা। রাস্তার ছিন্নমূল, অসুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য করেন চিকিৎসা এবং নাওয়া-খাওয়ার ব্যবস্থা। নিজ হাতে পরিচর্যা করেন রোগাক্রান্ত ও দুর্ঘটনার শিকার পশু-পাখির। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার রাস্তার পাশে লাগান হাজার হাজার বজ্রনিরোধক তালগাছ। বিদ্যালয় ঘুরে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করেন ঔষধি গাছ ও ভেষজ ওষুধ। আর এসবই তিনি করেন স্বেচ্ছাশ্রমে।
মানবসেবী এ মানুষটির নাম আব্দুল হামিদ। বয়স প্রায় ৬৫। নেত্রকোনার সবাই তাকে চেনেন 'বৃক্ষপ্রেমিক আব্দুল হামিদ' নামে। বাড়ি কেন্দুয়া উপজেলার দলপা-রামপুর গ্রামে। প্রায় ২০ বছর ধরে জেলা শহরের নেওয়াজনগর এলাকার ভাড়াবাড়িতে থাকেন। নিজের জায়গা-জমি বলতে কিছু নেই। জীবিকার জন্য একসময় রিক্সা চালাতেন। এখন সারাদিন মানবসেবা করে বেড়ান।
আব্দুল হামিদ যখন কিশোর, তখন তার মা ও এক ছোটবোন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাদের চিকিৎসা করেছিলেন নন্দীগ্রামের ইউনানী চিকিৎসক জগদীশ কবিরাজ। জগদীশের সান্নিধ্যে এসে আব্দুল হামিদ ঔষধি গাছের গুণাগুণ সম্পর্কে অবগত হন। এরপর প্রথমে নিজ গ্রামের (দলপা-রামপুর) এক ব্যক্তির পরিত্যক্ত ভিটায় গড়ে তুলেন প্রায় দেড়শ প্রজাতির ঔষধি গাছের বাগান। ২০০২ সালে মাত্র দেড়শ টাকা পুঁজি নিয়ে নেত্রকোনা শহরে এসে এ্যালোভেরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি গাছের শরবত বেচতে শুরু করেন তিনি। আস্তে আস্তে তার শরবতের চাহিদা বাড়ে। চাহিদা পূরণ করতে বিভিন্ন সরকারি অফিসের পরিত্যক্ত জায়গায় এ্যালোভেরা, তুলসী, নিশিন্দা, বহেরা, অর্জুন, আমলকি, হরিতকিসহ নানা প্রজাতির ঔষধি গাছ চাষ করতে শুরু করেন তিনি।
এভাবে চলতে চলতে ২০১২ সালে শহরের হাসপাতাল রোডের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে 'এলিফা ঔষধি দোকান' নামে ভেষজ ওষুধের দোকান দেন। দোকানটিতে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকার বিক্রয় হয়। এ দোকানের আয় দিয়েই কোনরকমে চলে সংসার। তার দুই ছেলে সোহেল ও হাবেল দোকানটি পরিচালনা করেন। আর তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন ঔষধি গাছের পরিচর্যা ও মানবসেবায়। বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজার এ্যালোভেরা ও অন্যান্য প্রজাতির গাছ আছে তার বাগানে। কিছু গাছ তার দোকানে ভেষজ ওষুধ তৈরির কাজে লাগান। আর বাকিগুলো শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মাঝে গিয়ে বিতরণ করেন। আব্দুল হামিদ জানান, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ৩০ হাজার এ্যালোভেরাসহ অন্যান্য ঔষধি গাছ বিতরণ করেছেন। শহরের বলাইনগুয়া এলাকার বাসিন্দা পল্লব চক্রবর্তী বলেন, 'নেত্রকোনা জেলার মানুষকে এ্যালোভেরা গাছ ও এর গুণাগুণ সম্পর্কে তিনিই প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।'
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে এবং আবর্জনার স্তুপ ঘেঁটে বিপুল পরিমাণ তালবীজ সংগ্রহ করেন বৃক্ষপ্রেমিক আব্দুল হামিদ। এরপর সেগুলো সংরক্ষণ করে বজ্রপাতপ্রবণ হাওর এলাকায় গিয়ে রোপন করেন। আব্দুল হামিদ জানান, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত হাওর এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার তালবীজ রোপন করেছেন। 'বারসিক' নামে একটি এনজিও তাকে এ কাজে সহযোগিতা করে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ফলজ ও ঔষধি গাছ রোপন, পরিবেশ ও নদী দূষণ রোধ, নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলা এবং পরিবেশ-সচেতনতামূলক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রচার করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন তিনি।
করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর থেকে নিয়মিত সতর্কবার্তা প্রচার করে যাচ্ছেন আব্দুল হামিদ। প্রতিদিন সকালে বাইসাইকেল অথবা ভ্যানগাড়ি ও হ্যান্ডমাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সন্ধ্যা পর্যন্ত শহর-জনপদ ঘুরে প্রচার চালান। মাস্কবিহীন লোকজনকে পরিয়ে দেন মাস্ক। সতর্ক-বার্তা প্রচারের জন্য তিনি বাইসাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন নেত্রকোনা থেকে ১শ ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঢাকা শহর পর্যন্ত। লকডাউনের সময় খাদ্যসঙ্কট দেখা দিলে অনেকের ঘরে নিরবে-নিভৃতে খাদ্য পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। সাম্প্রতিককালে হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতের প্রবণতা শুরু হওয়ায় সেখানে গিয়েও টানা কয়েকদিন সতর্কতামূলক বার্তা প্রচার করতে দেখা গেছে তাকে। এর আগে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সময়ও তিনি ঢাকাসহ অন্যান্য ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় গিয়ে সতর্ক-বার্তা প্রচার করেছেন।
২০১৮ সালের মে মাসে টর্নেডোয় নেত্রকোনা শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ অচল হয়ে গেলে খাবার পানির মারাত্মক সঙ্কট দেখা দেয়। আব্দুল হামিদ তখন টানা চারদিন ভ্যানগাড়ির সাহায্যে পাড়া-মহল্লা ঘুরে হাজার হাজার লিটার নিরাপদ পানি সরবরাহ করেন। মানুষ তখন তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে তার কাছ থেকে পানি সংগ্রহ করেন। একইভাবে ২০০৪ সালে কাঞ্চনপুরের ভয়াবহ টর্নেডোর সময়ও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি। রোহিঙ্গা সঙ্কটের সময় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে মসজিদে মসজিদে ঘুরে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করেন আব্দুল হামিদ। পরে ওই টাকায় খাদ্যসামগ্রী কিনে টেকনাফে গিয়ে বিতরণ করেন রোহিঙ্গাদের মাঝে। এছাড়াও বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও জনবহুল স্থানে গিয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্যবার্তা ও সড়ক দুর্ঘটনারোধে প্রচার চালান তিনি। অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন সচেতনতামূলক র্যালি ও সভা-সেমিনারে।
আব্দুল হামিদের বাবা সিরাজুল ইসলাম একবার বৃদ্ধবয়সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিরুদ্দেশ হন। ছয়দিন পর তাকে রাস্তায় খুঁজে পান। তখন থেকেই বৃদ্ধ, অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষদের প্রতি বিশেষ মায়া জন্মে তার। এরপর থেকে রাস্তার ভবঘুরে, মানসিক ভারসাম্যহীন, ছিন্নমূল, অসুস্থ ও অসহায় মানুষকে নানা ধরনের সেবা দিতে শুরু করেন তিনি। রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে তাদের খাওয়ান। গোসল করান। পুরনো কাপড় সংগ্রহ করে পরিয়ে দেন। জটবাঁধা চুল কেটে দেন। হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করেন। দানশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে ওষুধ কিনে দেন। অজ্ঞাত কেউ মারা গেলে করেন দাফন বা সৎকারের ব্যবস্থা। এরই মধ্যে ১৮জন প্রতিবন্ধীর মাঝে বিতরণ করেছেন হুইলচেয়ার। একই ধরনের সেবা দেন অসুস্থ ও দুর্ঘটনার শিকার হওয়া কুকুর, বিড়াল, শিয়ালসহ অন্যান্য পশু-পাখিদেরও। অষ্টম শ্রেণি পাশ আব্দুল হামিদ নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করেন। তার ফেসবুক পেজে রাস্তার ভবঘুরে, মানসিক ভারসাম্যহীন, অসুস্থ ও অসহায় মানুষদের ছবি প্রচার করেন। এতে অনেকে তাদের হারানো স্বজনদের খুঁজে পান। এভাবে বহু রাস্তার মানুষকে স্বজনদের কাছে তুলে দিয়ে অনন্য এক নজির স্থাপন করেছেন তিনি। তাই লোকজন রাস্তায় পড়ে থাকা কোন অসহায় বা বিপদগ্রস্ত মানুষকে দেখলেই আব্দুল হামিদকে খবর দেন। পরিচয়-ঠিকানা ও স্বজনহীন এসব মানুষকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক সময় হাসপাতালেই রাত কাটাতে হয় এই বৃদ্ধের। জরুরী সময়ে হাসপাতালের চিকিৎসাকর্মীদের কাজেও সহযোগিতা করতে দেখা যায় তাকে।
আব্দুল হামিদের কাছে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বেচ্ছাসেবার ব্রত নিয়ে এখন আরও অনেকে এগিয়ে আসছেন। ইতিমধ্যে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ২২জন তরুণ-তরুণী। এমনই একজন স্বেচ্ছাসেবক খলিল আহমেদ (২৯)। নেত্রকোনা সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে কর্মরত আনসার সদস্য খলিল। চাকরির পর অবসর সময়ে তিনি আব্দুল হামিদের সেবামূলক কাজে সহযোগিতা করেন। সিলেটের বালাগঞ্জের এই তরুণ বলেন, 'একজন মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি আমাদের কিছু কর্তব্য আছে। এটা আব্দুল হামিদের কাছ থেকে শিখেছি। এসব কাজ করে এক ধরনের তৃপ্তি পাই।' নাজমা, মিতু ও রুবিনা নামের আরও তিন তরুণী স্বেচ্ছাসেবক বলেন, 'হামিদ আঙ্কেল যখন কোন প্রচার-প্রচারণামূলক কাজে যান, তখন আমরাও অংশগ্রহণ করি। এসব কাজ করে আমাদের ভালো লাগে।'
আব্দুল হামিদের স্ত্রী-সন্তানরাও মানবসেবায় যুক্ত। তিন মেয়ের মধ্যে দুইজন বিবাহিত। বড় মেয়ে এলিফা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন। ছোট মেয়ে মাইমুন আক্তার ইতি নার্সিংয়ে পড়েন। এলিফা এবং ইতিকেও প্রায়সময় বাবার সঙ্গে প্রচার-প্রচারণা ও সেবামূলক কাজে অংশ নিতে দেখা যায়।
আগে আব্দুল হামিদকে নিজ খরচেই সবকিছু করতে হতো। এখন মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ আর্থিকভাবে তাকে সহযোগিতা করেন। নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মোঃ আবদুর রহমান সম্প্রতি নগদ ১০ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাকে। নেত্রকোনা মডেল থানার ওসি তাজুল ইসলাম ১৬ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ভ্যানগাড়ি কিনে দিয়েছেন। 'রক্তদানে নেত্রকোনা' নামে একটি সংগঠন তার পুরনো বাইসাইকেলটি মেরামত করে দিয়েছে। 'বারসিক' এনজিও প্রচার-কাজের জন্য একটি হ্যান্ডমাইক কিনে দিয়েছে। এমন আরও অনেক সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও দানশীল ব্যক্তি আছেন যারা বিভিন্ন সময়ে তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছেন। বারসিকের সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান বলেন, 'মানুষের দেয়া টাকা থেকে একটি টাকাও নিজের জন্য ব্যয় করেন না তিনি। নিজে না খেয়েও বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান। তাকে টাকা দিলে অপব্যবহার হয় না।'
আব্দুল হামিদের সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নেত্রকোনার নাগরিক সংগঠন 'সুশাসনের জন্য নাগরিক' (সুজন) এর সভাপতি শ্যামলেন্দু পাল বলেন, 'সমাজের সব ভালো কাজে তাকে পাওয়া যায়। মানবসেবাই যেন তার জীবনের ব্রত। তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া উচিত। তাকে উৎসাহিত করলে তার দেখাদেখি আরও অনেকে এমন সেবামূলক কাজে উৎসাহিত হবেন।'
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মোঃ আবদুর রহমান বলেন, 'আব্দুল হামিদ একজন নিঃস্বার্থ স্বেচ্ছাসেবক। নিজের জন্য কিছু চান না। সব সময় অন্যদের নিয়ে ভাবেন। তার মতো মানুষ সমাজে বিরল। করোনাভাইরাসজনিত দুর্যোগের প্রচারসহ আমাদের অনেক কাজের সঙ্গে তাকে যুক্ত করেছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার জন্য একটি মাসিক ভাতা দেয়ার চিন্তা করছি আমরা।'
সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য হাবিবা রহমান খান শেফালী বলেন, 'বৃক্ষপ্রেমিক আব্দুল হামিদ একজন আর্তমানবতার সেবক। আর্তমানবতার পাশাপাশি তিনি পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। আমিও তাকে সহযোগিতা করব।'
কারও কাছে কিছু চান কি না জানতে চাইলে আব্দুল হামিদ বলেন, 'আমার নিজের জন্য কিছু চাই না। কিন্তু আমি যখন কোন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই অথবা কোন জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রচার করতে চাই তখন কিছু খরচাদি হয়। সামর্থের অভাবে অনেক সময় তা জোগাড় করতে পারি না। ওই সময় যদি সমাজের বিত্তবান বা মানবতাবাদী লোকজন কিছুটা সাড়া দেন তাতেই আমি খুশি।' এছাড়া স্থায়ীভাবে একটি খালি জমি পেলে সেখানে ঔষধি গাছের বাগান করারও ইচ্ছে আছে তার।