প্রাদুর্ভাব, মহামারি এবং বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে পার্থক্য কী?
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মারাত্মক প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চীন, ইতালি, ইরান, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের ৪ হাজার ৬৩৮ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া এই রোগটিকে বুধবার রাতে এই স্বীকৃতি দেয় সংস্থাটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক 'বৈশ্বিক মহামারি' হিসেবে ঘোষণার আগে কোভিড-১৯ ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট এই রোগটি আরও দুটি ধাপ পেরিয়ে আসে। সে দুটি হলো 'প্রাদুর্ভাব' এবং 'মহামারি' ধাপ। এই তিনটি ধাপের কোনটির কী অর্থ তা আমরা এখন জানবো।
প্রাদুর্ভাব: ছোট পরিসরে কিন্তু অস্বাভাবিক
সারা বিশ্বের সব দেশেই মানুষ অসুস্থ্য হন, অসুস্থ্য হয়ে ডাক্তারের কাছে যান এবং চিকিৎসা নেন। এটা খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এপিডেমাইওলজিস্ট'রাও (মহামারী বিদ্যা-সংক্রান্ত চিকিৎসক) এটি বেশ স্বাভাবিকভাবেই নেন। তবে স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চ মাত্রায় যদি কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়ে তবে সেটি 'প্রাদুর্ভাব' এর পর্যায়ে চলে যায়।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে এটি পরিষ্কার করে বোঝানো সম্ভব। ধরা যাক কোনো ডে-কেয়ার সেন্টারে সপ্তাহে দুজন শিশু ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হয়। এটিকে স্বাভাবিক একটি ঘটনা হিসেবেই ডাক্তাররা বিবেচনা করেন। তবে সপ্তাহের ব্যবধানে আক্রান্তের সংখ্যাটি যদি ১৫ জনে পৌঁছায় তখন আর সেটি স্বাভাবিক থাকে না। সেটি 'প্রাদুর্ভাব' হয়ে যায়। তখন বলা হয়, ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
উহানের একটি বাজারে যাতায়াতকারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম একধরণের নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। স্থানীয় কর্মকর্তারা পরে বুঝতে পারেন, করোনা ভাইরাসের ফলেই ওই নিউমোনিয়া হয় যা পরবর্তীতে নাম পায় কোভিড-১৯।
প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ যদি আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবে সেটা আর মহামারিতে যেতে পারে না।
মহামারি: বড় পরিসরে এবং ছড়িয়ে পড়তে থাকে
কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব যখন অনেক বড় এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তখন এটিকে 'মহামারি' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। করোনা ভাইরাস যখন চীনের উহান শহরের বাইরেও অন্যান্য যায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল তখন এপিডেমাইওলজিস্টরা বুঝতে পারেন ততক্ষণে এটি মহামারিতে পরিণত হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় এখনও কোনো ভ্যাকসিন বা ঔষধ আবিষ্কার হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে এর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কেও চিকিৎসকদের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। ফলশ্রুতিতে এটি দ্রুতই মহামারিতে পরিণত হয়।
বৈশ্বিক মহামারি: আন্তর্জাতিক পরিসরে এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে
চিরায়ত ধারণা অনুযায়ী, কোনো মহামারি রোগ যখন বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে বৈশ্বিক মহামারি বলা হয়। তবে কোনো কোনো এপিডেমাইওলজিস্ট মহামারি অবস্থাকে তখনই প্যানডেমিক হিসেবে ঘোষণা করেন যখন তা আক্রান্তের যাতায়াতের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যদি চীনের উহান থেকে বাংলাদেশ কিংবা ওই ব্যক্তির নিজ দেশে ফিরে যান, তার অর্থ এই নয় যে রোগটি বৈশ্বিক মহামারি হয়ে গেলো। কিন্তু ওই ব্যক্তির মাধ্যমে রোগটি যখন তার পরিবার, বন্ধু বা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তখনই এটি নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়। রোগটির স্থানীয় এই প্রাদুর্ভাব থেকে এপিডেমাইওলজিস্টরা যখন বুঝতে পারেন রোগটি বৈশ্বিকভাবেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে তখন তারা এটিকে প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে বিবেচনা করেন।
এই তিনটি শব্দ যতোটা না চিকিৎসা সংক্রান্ত, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক
এপিডেমাইওলজিস্ট বা মহামারী বিদ্যা-সংক্রান্ত চিকিৎসক এবং সরকার অথবা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের ধরণ ও ক্ষেত্র আলাদা আলাদা। এপিডেমাইওলজিস্টরা সাধারণত ছড়িয়ে পড়া কোনো মহামারির প্রতিরোধ বা চিকিৎসা নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু এই মহামারির ঘোষণা দিয়ে থাকে বিভিন্ন দেশের সরকার বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ পর্যন্ত মাত্র দুটি রোগকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ২০০৯ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা এইচ-১ এন-১ কে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের ১১৬টি দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর কোভিড-১৯ কে বুধবার রাতে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করে। মারাত্মক প্রাণঘাতী এই রোগে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৬৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি হলো সারাবিশ্বের সবগুলো দেশের জন্য স্বাস্থ্যখাতের জরুরী অবস্থা। তবে করোনা ভাইরাসের এই জরুরী অবস্থা ঘিরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবৃতি আমাদের আশান্বিত করে। সংস্থাটি বলছে, এখনও এই রোগের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব।
কোনো রোগকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করার আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়। কেননা এই ঘোষণার ফলে বিশ্বের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিকসহ বহু কার্যক্রম থমকে যায়।