প্রিয় নীল জিন্সও সমুদ্র দূষণ করছে!
ইয়োগা প্যান্ট বা মোজার মতো সিনথেটিক কাপড়ের মাইক্রোফাইবার সমুদ্র দূষণে ভূমিকা রাখছে, ইতোমধ্যেই তা জেনেছেন অনেকে। বিশেষ করে, সিনথেটিক তন্তু দিয়ে তৈরি এসব কাপড় ধোয়ার ফলে অতিক্ষুদ্র ফাইবার কণা পানিচক্রের মাধ্যমে সাগরে গিয়ে পড়ে। এমনকি উন্নত বিশ্বের শহরগুলোয় স্থাপিত পানি শোধনাগারও এসব সূক্ষ্ম আঁশকণার অধিকাংশকে সরাতে পারে না। পাশাপাশি কাপড় শুকানোর প্রক্রিয়াতেও ফাইবার কণা বাতাসে মিশছে।
গভীর সমুদ্রতল হোক বা উপকূলীয় অঞ্চলের সাগরের পানি, সবখানেই ৫ মিলিমিটারের কম দৈর্ঘ্যের মাইক্রোফাইবারের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু তাদের আশা ছিল, জৈব উৎস থেকে সংগ্রহ করা তন্তু যেমন; আমাদের অনেকের প্রিয় জিন্স তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানের ক্ষয় হয়তো প্লাস্টিকজাত তন্তুর ন্যায় সমুদ্র দূষণ বাড়াবে না। কারণ প্রাকৃতিক নিয়মেই তুলা থেকে তৈরি এসব জৈব উপাদান পানিতে দ্রবীভূত হওয়ার সক্ষমতা রাখে।
সে আশাটি হতাশায় রূপ নিয়েছে বিজ্ঞানীদের। আজ বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) বৈজ্ঞানিক সাময়িকী- জার্নাল এনভায়রোমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি লেটার্সে লেখা এক নিবন্ধে হতাশার কারণ তুলে ধরেছেন টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
মানুষের বড় বসতি থেকে বহুদূরে কানাডার উত্তর মেরু সাগরের তলদেশ থেকে সংগৃহীত পলিতে নীল ডেনিম জিন্সের আণুবীক্ষণিক কণার ব্যাপক পরিমাণ উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন তারা। এবং দেখা যাচ্ছে, অপ্রাকৃতিক এক বৈশিষ্ট্যে রূপ নিয়েছে ডেনিমের তন্তুকণা।
পরিবেশ বিজ্ঞানী এবং গবেষণা নিবন্ধের সহ-লেখক স্যাম অ্যাথি বলেন, ''এই অনুসন্ধান এটাই প্রমাণ করে যে, সমুদ্রস্রোত চক্রের হাত ধরেই অনেকদূর থেকে আসা এসব সূক্ষ্ম তন্তুকণা উত্তর সাগরের তলদেশে জমা হয়েছে। এগুলো বায়ুমন্ডল থেকে সমুদ্রে পড়েছে নাকি পানিচক্রের মাধ্যমে এসেছে-সেটা আমরা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।''
তবে দুই ধরনেই সমুদ্রে তন্তুকণার উপস্থিতি বাড়তে পাড়ে। এর আগে বিজ্ঞানীরা গভীর সাগরের জলস্রোত কীভাবে মাইক্রোফাইবার পৃথিবীর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়; তা এক ব্যবহারিক মডেলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন। তাছাড়া, বাতাসে ভর করে কীভাবে সুদূর ইউরোপের নানা শহর থেকে থেকে সূক্ষ্ম প্লাস্টিক কণা উত্তর মেরুতে আসছে, সেটাও তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হন।
''ব্লু জিন্সের ব্যবহৃত তন্তুকে সংশ্লিষ্ট শিল্পে- আন্থ্রোপোজেনিক্যালি মডিফায়েড সেলুলোজ বলা হয়। সেলুলোজ হচ্ছে এমন এক ধরনের উদ্ভিজ্জ উপাদান যা প্রাকৃতিক তুলায় থাকে। এটি প্রাকৃতিক বয়ন তন্তু হিসেবেও পরিচিত।''
অ্যাথি বলেন, আমি 'প্রাকৃতিক' শব্দটি নিয়ে একটু সতর্ক হতে চাই, কারণ শিল্পোৎপাদনের প্রক্রিয়ায় এতে রাসায়নিক উপাদান যোগ করা হয়। এভাবে প্রস্তুত করা পরিধেয় বস্ত্র চারপাশের পরিবেশ থেকেও রাসায়নিক উপাদান শোষণ করে। আপনি কাপড়টি পড়ে ঘুরে বেড়ান বা আলমারিতে তুলে রাখুন, যেকোনো পরিবেশ থেকেই রাসায়নিক টেনে নিতে পারে এটি।
ডেনিম কাপড়ের সব সূক্ষ্ম তন্তুকণা মাইক্রোফাইবার। তবে সব মাইক্রোফাইবার কিন্তু ডেনিম তন্তু নয়। পলেস্টার জাতীয় তন্তুও ব্যবহার করা হয় ডেনিম কাপড়ে। তবে একসঙ্গে নীলরঙ করার প্রক্রিয়ায় এদের দৃশ্যমান বর্ণ একইরকম হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক ও প্লাস্টিক উপাদানের এই সূক্ষ্ম বুননই ডেনিম কাপড়ের তন্তুকে এক স্বতন্ত্র মিশ্র বৈশিষ্ট্যে রূপ দেয়।
গঠনপ্রক্রিয়ার এ ভিন্নতা শনাক্ত করার মাধ্যমেই উত্তর সাগরের পলিতে বিদ্যমান জিন্সের মাইক্রোফাইবার অন্য উপাদান থেকে সহজেই আলাদা করতে পেরেছেন টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈজ্ঞানিক দলটির সদস্যরা। এজন্য তারা ব্যবহার করেছেন 'রামান স্পেকট্রোস্কপি' নামের এক প্রক্রিয়া। এটি কোনো উপাদানের রাসায়নিক গঠন অনুসারে আলোকরশ্মির প্রতিফলন শনাক্তের প্রক্রিয়া। তাছাড়া, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আতশকাঁচ তলের যুগ যুগ ধরে প্রচলিত পরীক্ষার প্রক্রিয়াটি তো ছিলই।
এভাবে শিল্প প্রক্রিয়ায় বৈশিষ্ট্য রূপান্তরিত জিন্সের মাইক্রোফাইবার যে অন্য কোনো পলেস্টার বা নাইলনের কণা নয়, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হন বিজ্ঞানীরা।
নিচের ছবিতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে নীল জিন্সের তন্তুর আণবিক গঠনে এমন এক বৈশিষ্ট্য রয়েছে; যা প্রাকৃতিক আঁশের ন্যায় অনেক মসৃণ কিন্তু এরমধ্যে থাকা ভাঁজগুলো এটি যে রূপান্তরিত উপাদান, সে পরিচয় উন্মোচন করে দেয়।
শুধু উত্তর সাগর নয়, বিজ্ঞানীরা অন্যান্য জলজ বাস্তুসংস্থানের তলদেশ থেকেও পাললিক স্তরের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এরমধ্যে কানাডার টরেন্টো নগরের চারপাশে থাকা হ্রদ; হুরন এবং গ্রেট অন্টারিও লেক থেকেও নমুনা নেন তারা।
নমুনা বিশ্লেষণে উত্তর সাগর, হুরন এবং অন্টারিও লেকের প্রতি কেজি পলিতে পাওয়া মাইক্রোফাইবার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে; ১৯৩০, ২৪৯০ এবং ৭৮০টি। এর মধ্যে আন্থ্রোপোজেনিক্যালি মডিফায়েড সেলুলোজ কণা ছিল ২২-৫১ শতাংশ। যার মধ্যে আবার নীল ডেনিম কাপড়ের সূক্ষ্মকণা ছিল ৪১-৫৭ শতাংশের মতো। অর্থাৎ, প্রকৃতিতে ডেনিমের বিপুল উপস্থিতি ছিল স্পষ্ট।
''আশ্চর্য্যজনক বিষয় হচ্ছে, এপর্যন্ত আমরা যেসব সূক্ষ্মকণা প্রত্যক্ষ করেছি তার বড় অংশই ছিল গঠন বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত সেলুলোজ আঁশ থেকে এসেছে। সাগরের গভীর তলদেশেও এর সরব উপস্থিতি ছিল। এতে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান বিপন্ন হওয়ার নতুন ঝুঁকি আশঙ্কা করছি আমরা'' বলেন স্যাম অ্যাথি।
তাছাড়া, ধোয়ার প্রক্রিয়ায় কী পরিমাণ আঁশ ক্ষয় হয়ে মাইক্রোফাইবার তৈরি হচ্ছে, তা জানতে ৯৯ থেকে ১০০ শতাংশ তুলার তন্তু থেকে তৈরি তিন ধরনের জিন্স ওয়াশিং মেশিনে ধোয়ার পরীক্ষা করেন বিজ্ঞানীরা। ব্যবহৃত জিন্স, একদম নতুন জিন্স এবং কিছুটা জীর্ণ জিন্স- এ তিন ধরনের কাপড় তারা ওয়াশিং মেশিনে দেন। এরপর মেশিনে রয়ে যাওয়া ফাইবার তারা গণনা করেন।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষয় হয় নতুন জিন্সের। এর কারণ হচ্ছে, পুরোনো জিন্সের ঢিলেঢালা তন্তুগুলো অনেক আগেই ঝরে যায়। তবে নতুনের সঙ্গে জীর্ণ জিন্স ক্ষয়ের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, খুব বেশি পরিমাণ ব্যবহারের ফলেই এধরনের ক্ষয় সৃষ্টি হয় জীর্ণ জিন্সে।
পরীক্ষার সামগ্রিক ফলাফলে বিজ্ঞানীরা জানান, নতুন একজোড়া জিন্স প্রতিবার ধোয়ার ফলে ৫৬ হাজার মাইক্রোফাইবার উৎপন্ন হয়ে থাকে। যা সামুদ্রিক জীবনের জন্যে যেমন বিপদ, ঠিক তেমনি খাদ্যচক্রের মাধ্যমে তা মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিটাও এখন বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে।