ফুটপাত থেকে ফেসবুক: প্রযুক্তি দুনিয়ায় হাবিব চাচার ঐতিহ্যবাহী বইয়ের দোকান
রাজধানীর শাহবাগে সুফিয়া কামাল ন্যাশনাল পাবলিক লাইব্রেরির কাছে রাস্তার ধারে ছোট একটি বইয়ের দোকান রয়েছে। রাস্তার পাশের বেশিরভাগ দোকানগুলোর মতো নামফলক না থাকা এই বইয়ের দোকানে দুটি কাঠের তাক দিয়ে ঘেরা একটি টুলের ওপর বসে থাকতে দেখা যায় একজন বয়স্ক লোককে। 'হাবিব চাচার বইয়ের দোকান' চিনতে এ বিবরণই যথেষ্ট।
দোকানটি শহরের অন্যতম ব্যস্ত একটি এলাকায় অবস্থিত। টিএসসিকে শাহবাগ মোড়ের সঙ্গে যুক্ত করা দীর্ঘ রাস্তার উপরে বসা এ দোকানে সাম্ভাব্য ক্রেতার অভাব হয় না। হাবিব চাচার সঙ্গে কোনো ক্রেতার বই নিয়ে দর কষাকষি করতে থাকা আদতে নিত্যদিনের একটি সাধারণ দৃশ্য।
হাবিব চাচা শুধুমাত্র বই বিক্রেতাই নন, বরং তিনি আপনাকে বই সম্পর্কে বিশদ পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি অনেক আকর্ষণীয় বইপত্রের খণ্ডের পরামর্শও দিতে পারবেন।
বই সম্পর্কে তার জ্ঞান নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'গত ৩৮ বছর ধরে যে বইগুলো আমাকে জীবিকা সরবরাহ করে আসছে, ওদের সম্পর্কে আমি কী করে অজ্ঞ থাকি?'
একজন বই ব্যবসায়ীর যাত্রা
১৯৭১ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান তার গ্রাম নরসিংদী ছেড়ে ভাগ্যসন্ধানে ঢাকা চলে আসেন। শহরে এসে নানা চাকরির চেষ্টার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও করেন। অবশেষে ১৯৮৪ সালে সদরঘাটে হাবিবুর রহমান নিজের একটি বইয়ের দোকান খুলেন। তখন থেকেই তিনি বই বিক্রি করে আসছেন।
তিনি বলেন, 'আমি তখন ছোট ছিলাম এবং স্বাধীনভাবে কিছু করতে চেয়েছিলাম। সেকালে লেখক ও পাঠকদের কেন্দ্র ছিল বাংলাবাজার। প্রথমদিকে হওয়া কিছু সংগ্রামের পর এ ব্যবসা আমার পায়ের নিচের মাটি তৈরি করে দেয়।'
সময়ের পরিক্রমায় হাবিব সদরঘাট থেকে মতিঝিল, এবং শেষমেশ ২০০১ সালে তার বর্তমান অবস্থান শাহবাগে আসেন।
'এখানে সবসময়ই উৎসাহী ছাত্রছাত্রী ও বইপোকাদের ভিড় থাকে। তাদের আলাপ ও এই তারুণ্যময় পরিবেশ আমি পছন্দ করি। ফলে গত দুই দশকে আমার কখনোই এ জায়গা ছেড়ে যাবার কথা মনে হয়নি। বরং এখন এটি আমার কাছে নিজের বাড়ির মতোই,' বলছিলেন হাবিব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই মূলত হাবিব চাচার বইয়ের গ্রাহক। স্বাভাবিক সময়ে তিনি দিনে প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি বই বিক্রি করেন। তার সব নিয়মিত গ্রাহককে তিনি চেনেন দাবি করে হাবিব বলেন, 'প্রাণবন্ত এ তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আমি ধন্য।'
তিনি আরও বলেন, 'ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমার বেশ কিছু আনন্দদায়ক স্মৃতিও রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে চিনি, যারা নিজেদের খাবারের খরচ বাঁচিয়ে বই কেনে। আবার অনেক ছাত্রছাত্রী চাকরি পাওয়ার পর বা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর আমাকে ফোন করে। যখন তারা তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন হিসেবে আমাকে বিবেচনা করে, তখন আমার খুব ভালো লাগে।'
কোভিডের প্রভাব
গত বছরের এপ্রিলে শুরু হওয়া কোভিডের প্রাথমিক লকডাউন অনেক কুটির-স্তরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য আর্থিক সংকটের সূচনা করে। হাবিবুর রহমানও সে সংকট থেকে তার বইয়ের এই ক্ষুদ্র ব্যবসা রক্ষা করতে পারেননি। হতাশার সঙ্গে তিনি বলেন, 'মাসের পর মাস ধরে আমি দোকান খুলতে পারছিলাম না। অনেক বছরের চেষ্টায় এ ছোট ব্যবসা আমি গড়ে তুলেছি। কিন্তু হঠাৎই মনে হলো ব্যবসাটি ভেঙে পড়বে।'
এমন সময় হাবিবের কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী তার ছেলে মোহাম্মদ ইমন রহমানকে অনলাইনে একটি বইয়ের দোকান খোলার পরামর্শ দেন। হাবিবের কনিষ্ঠ ছেলে ২০ বছর বয়সী ইমন এক্ষেত্রে তার বাবার ব্যবসার জন্য বড় একটি আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেন।
ইমন বলেন, "বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র আমাকে একটি ফেসবুক পেজ খোলার পরামর্শ দেন। ফেসবুকে কী করে প্রচারকাজ চালাতে হয়, সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। তবে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, তারা পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি আমার পেজ 'বুক ডেস্টিনি' তৈরিতেও সাহায্য করেছেন।"
ইমন বয়সে ছোট হলেও নীলক্ষেত বইয়ের বাজারের একজন দক্ষ অপারেটর। গত পাঁচ বছর ধরে এ বাজারে তিনি কাজ করছেন। এই বইয়ের বাজারের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত সকল খবর তিনি জানেন বলে দাবি ইমনের। তিনি বলেন, 'আমি জানি কোথায় ও কীভাবে এ বইগুলো প্রকাশিত ও বিপনন করা হয়।'
মূলত শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার এ অভিজ্ঞতা তাকে উদ্যোক্তা হওয়ার দক্ষতা বিকাশে সাহায্য করেছে। ইমন বলেন, 'মূলধারার অফলাইন ও অনলাইন ব্যবসা আলাদা। অনলাইন ব্যবসা মূলত বেচাকেনা এবং চাকচিক্যের ওপর নির্ভর করে। অনলাইনে প্রচার চালানোর জন্য আমি আকর্ষণীয় স্লোগান-সহ বইয়ে মূল্যে ছাড় দেওয়ার ঘোষণা এবং বইয়ের প্রচ্ছদ আপলোড করেছি।'
হাবিবুর রহমানের নিয়মিত গ্রাহকদের মধ্যে 'বুক ডেস্টিনি' পেজটি ইতোমধ্যেই শেয়ার করা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হলেও ইমনের কাছে নিজে থেকে এ পেজ চালানো কঠিন বলে মনে হয়েছে।
নতুন উদ্যোগ গ্রহণ
প্রথম লকডাউনের সময় ইমন ফেসবুক মার্কেটিং ও প্রচারের মৌলিক নিয়মগুলো শিখেছেন। প্রায় ১১ হাজার ফলোয়ার তার প্রচেষ্টারই চিত্র তুলে ধরে। অনলাইন উদ্যোগে প্রাথমিক সাফল্য পেয়ে ইমন তার বাবার ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাকে পরবর্তী স্তরে পৌঁছে দিতে এগিয়ে আসেন।
স্বাভাবিক দিনগুলোতে সপ্তাহের ৭ দিনই হাবিবুর রহমান তার বইয়ের দোকান নিয়ে বসেন। ইমন তার বাবাকে দোকানে সাহায্য করার পাশাপাশি অনলাইনে 'বুক ডেস্টিনি'ও চালান। যখনই কোনো গ্রাহক হাবিবের কাছে কোনো বইয়ের সন্ধান না পান, তিনি নিজেদের অনলাইন দোকানের কথা জানান তাদেরকে। হাবিব ও তার ছেলের মধ্যকার পারস্পরিক এ নির্ভরশীলতাই তাদেরকে লকডাউনের সংকটপূর্ণ অবস্থায় সাহায্য করে আসছে।
সাম্প্রতিক সময়ের লকডাউন হাবিবের জন্য আরেকটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু তিনি নিয়মিত তার দোকান খুলে বসেন। হাবিবের বয়স এখন ৬৬ বছর। প্রতিদিন সকালে বাসে বা রিকশায় করে যাত্রাবাড়ী থেকে শাহবাগ আসেন তিনি।
হাবিব বলেন, 'আমি এখানে আমার বই নিয়ে বসে থাকি। যদি পুলিশের কেউ দোকান বন্ধ করতে বলে, তাহলে আমি সম্মানের সঙ্গে তাদের কথা শুনি। বইয়ের বিক্রি এখন যদিও কম, তবু জানি, লকডাউনের পর এটি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।'
'আমার যা কিছু আছে, তা নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। এখন আমার ছেলে ইমনকে একটি দোকান দিয়ে বসাতে চাই। সেও অনলাইন উদ্যোগের পাশাপাশি একজন সফল বই প্রকাশক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়,' যোগ করেন হাবিব।