বাংলাদেশের বিস্ময়কর প্রজাপতি
বাংলাদেশে বর্তমানে ৪০০টিরও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। একটা ছোট দেশের জন্যে এ সংখ্যাটি বিস্ময়কর। প্রতি বছর দেশের নানা প্রান্তে নতুন নতুন প্রজাপতি আবিষ্কৃত হচ্ছে।
প্রজাপতি খাবারের জন্য গাছ গাছে উড়ে বেড়ায়। এরা গাছের রস, মধু, পুষ্টি-সমৃদ্ধ জলধারার পানি, পচা ফলের রস ও পশুপাখির বিষ্ঠা খায়।
খাদ্যচক্রে প্রজাপতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা পাখি, টিকটিকি এবং উভচর প্রাণীদের শিকার। আদতে কোনো বাস্তুতন্ত্র কতটা ভালো আছে, তার নির্দেশক হচ্ছে প্রজাপতি। আর জৈবিকভাবে এই শুভ-লক্ষণ দেখানো জীবের প্রাচুর্য বাংলাদেশ ভরপুর।
তুষারে-মোড়ানো অ্যান্টার্কটিকা বাদে বিশ্বব্যাপী প্রজাপতির বিচরণ রয়েছে। পৃথিবীতে প্রায় ১৯ হাজার প্রজাতির প্রজাপতি আছে। তার প্রায় এক-চতুর্থাংশই অস্ট্রেলীয় অঞ্চলে বাস করে।
ভারতীয় ও আফ্রিকান প্রজাপতি নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করা ড্যানিশ পতঙ্গ বিশেষজ্ঞ টোরবেন বি লারসেনের অনুমান, বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে।
এমনকি বাংলাদেশের প্রজাপতি বিশেষজ্ঞরা যে সংখ্যক প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন, তা লারসেনের উল্লেখিত সংখ্যার বেশ কাছাকাছি। দেশে ইতোমধ্যে ৪০০টির বেশি প্রজাতি রেকর্ড করা হয়েছে। সিলেট ও চট্টগ্রামের মিশ্র চিরহরিৎ বন বৈচিত্র্যময় প্রজাপতির ভান্ডার।
গোপন জীবনের মধ্যে:
আমরা সচরাচর যেসকল প্রজাপতি দেখি, সেগুলো সবই প্রাপ্তবয়স্ক। অন্যান্য পোকামাকড়ের মতো প্রজাপতিরও একটা জীবনচক্র আছে। ডিম থেকে লার্ভা আকারের একটি জড়, আবার মৃতবৎ শুঁয়োপোকা থেকে চূড়ান্ত প্রজাপতি রূপ পর্যন্ত আসতে তাদের ৪ টি ধাপ পেরোতে হয়।
প্রতিটি প্রজাপতির জীবনের সাথে এক বা দুই প্রজাতির উদ্ভিদ জড়িয়ে থাকে। কিছু কিছু প্রজাপ্তি কেবল এক প্রজাতির উদ্ভিদের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। বাকিরা হরেক প্রজাতির উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে।
এ কারণে যেকোনো জায়গায় প্রজাপতির বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য নির্ভর করে সেখানকার পোষক উদ্ভিদের প্রাপ্যতা ও প্রাচুর্যের ওপর। এসব উদ্ভিদ নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রজাপতিকে আশ্রয় দেয় বলে এরা পোষক-নির্দিষ্ট উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। নারী প্রজাপতি এসব উদ্ভিদের ডালে এক থেকে কয়েক ডজন পর্যন্ত ডিম পাড়ে। ডিম্বা-দশা কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। কয়েক সপ্তাহ পর ডিম ফুটে লার্ভা বেরিয়ে এসে গাছের পাতা খাওয়া শুরু করে।
পুরোপুরি বেড়ে ওঠার পর লার্ভাগুলো খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং একটি নিরাপর স্থানে—বেশিরভাগ সময়ই কোনো পাতার নিচে—ক্রাইসালিস নামক শক্ত খোসার সাহায্যে নিজেদের আবৃত করে রাখে। এ পর্যায় থেকে শুরু করে প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত খোলসের ভেতর তারা ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়।
প্রজাপতি এক সপ্তাহ থেকে প্রায় এক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। অনেক প্রজাতির জীবনের লার্ভা পর্যায়ের সময়কাল বেশি থাকে, আবার অনেক প্রজাতি শুঁয়ো বা ডিম্ব দশায় পুরো শীতকাল সুপ্ত অবস্থায় কাটিয়ে দেয়।
উড়ন্ত সৌর প্যানেল:
প্রজাপতির ডানা কেবল সাজসজ্জা ও ওড়ার জন্য নয়। ডানার এই প্রাণবন্ত রং সঙ্গি/সঙ্গিনীর সঙ্গে বন্ধন দৃঢ় করতে এবং শিকারীকে ধোঁকা দিতে সাহায্য করে।
এছাড়াও, প্রজাপতির ডানা শক্তি রূপান্তর করতে পারে। প্রজাপতির ডানা মূলত লক্ষ লক্ষ ঝিল্লী ও রঞ্জক ন্যানো স্কেল দিয়ে তৈরি। এই স্কেলগুলো সৌর প্যানেলের একটি জটিল নেটওয়ার্ক তৈরি করে যা সূর্যালোক থেকে তাপ শোষণ করে।
এরপর শোষণ করা তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং সেই শক্তি ডানার শিরা-উপশিরার মাধ্যমে বক্ষের মধ্যে চলে যায়। এ শক্তি ওড়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
দূরবর্তী অভিবাসন:
পাখি, মাছ, ডলফিন এবং কচ্ছপের মতো অনেক প্রজাপতিও দূর-দূরান্তে অভিবাসন করে। এ কাজের জন্য প্রজাপতি সূর্যকে কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করে এবং রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে পথ ঠিক রাখে।
তবে প্রজাপতিরা প্রজন্মের মাধ্যমে এই স্থানান্তর ঘটিয়ে থাকে। তারা তাদের এই যাত্রার মধ্যে প্রজনন ঘটায় এবং পুরো যাত্রায় কয়েক প্রজন্মের ধারা শেষ করে।
একটি ইউরো-আফ্রিকান প্রজাতির প্রজাপতি ৯ হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয় একটি অভিবাসন সম্পন্ন করে। ক্রান্তীয় আফ্রিকা থেকে আর্কটিক সার্কেলে একটি অভিবাসন সম্পন্ন করার জন্য পরপর ছয় প্রজন্ম লেগে যায়।
ভারতীয় প্রজাপতির অভিবাসন মৌসুমের ওপর নির্ভরশীল। এখানকার প্রজাপতিদের অভিবাসন সাধারণত অক্টোবরে দক্ষিণ ভারত থেকে শুরু হয়। তারা ফিরতে শুরু করে এপ্রিলে।
বাংলাদেশে প্রজাপতির অভিবাসন নিয়ে তেমন গবেষণা হয় না। তবু এ দেশে পেইন্টেড লেডি, লাইম সোয়ালোটেইলস, ইমিগ্র্যান্ট এবং টাইগারসহ বেশ কিছু স্থানীয় ও ট্রান্স-বাউন্ডারি অভিবাসী প্রজাতির প্রজাপতির সন্ধান পাওয়া গেছে।
ক্ষুদ্রতম, বৃহত্তম ও স্থানীয়:
বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জাতের প্রজাপতি হলো ওরিয়েন্টাল গ্রাস জুয়েল। এদের ডানার বিস্তার ২০ থেকে ২২ মিলিমিটার। নীল বর্ণের এই প্রজাপতির খোঁজ প্রথম পাওয়া যায় ২০১৪ সালে, ঢাকার কেরানিগঞ্জে। সম্প্রতি রাজশাহীর নদীতীরেও এ প্রজাতির দেখা পাওয়া গেছে।
দ্য গোল্ডেন বার্ডউইং বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রজাতির প্রজাপতি। এর ডানার বিস্তার ১১৯ থেকে ১৮৮ মিলিমিটার। সোয়ালোটেইল গোত্রের এই প্রজাপতিটি শুধু পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি অরণ্যে পাওয়া যায়। প্রথম দেখায় একে কাল ডানাওয়ালা ছোট্ট হলদে পাখির মতো দেখায়।
সম্প্রতি দ্য সুন্দরবন ক্রো নামের একটি বিপন্ন প্রজাতির প্রজাপতি সুন্দরবনের কটকা ও কচিখালীর তৃণভূমিতে পাওয়া গেছে। এটিই একমাত্র বাংলাদেশি প্রজাপতি যা বিশ্বের অন্য কোনো অঞ্চলে পাওয়া যায়নি।
আমাদের প্রজাপতিগুলো কতটা হুমকির মুখে?
বাংলাদেশে প্রজাপতি নিয়ে গবেষণা কম হয়। ২০১৫ সালের থ্রেট অ্যাসেসমেন্টে দেশের ৩০৫টি প্রজাতিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। পরবর্তীতে পতঙ্গ বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এ তালিকাকে অসম্পূর্ণ উল্লেখ করে তালিকাটি নতুন করে তৈরি করার পরামর্শ দেন।
এ কথা সত্য যে, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া দেশীয় পোষক উদ্ভিদের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি, কীটনাশক ব্যবহার, এবং বন ও বাস্তুতন্ত্রের রূপান্তর প্রজাপতিগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এসব হুমকি ২০১৫ সালের মূল্যায়ন তালিকায় বিবেচনা করা হয়নি।
এছাড়াও প্রজাপতির হটস্পটগুলো চিহ্নিত করার জন্যেও একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ জরিপ প্রয়োজন।
প্রজাপতি দেখা: একটি শখ
প্রজাপতি দেখা ও এর ছবি তোলা একটি জনপ্রিয় শখ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে সাধারণত সব জায়গায়, এমনকি ঢাকা শহরের পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনেও প্রজাপতি পাওয়া যায়। শহরে ১৪০টিরও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিওন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর মতো এনজিওগুলো প্রতিবছর প্রজাপতি মেলার আয়োজন করে। এসব আয়োজন প্রজাপতি দেখা, গবেষণা ও সংরক্ষণে উৎসাহ দেয়। প্রজাপতির প্রজাতি আবিষ্কার ও গবেষণার জন্যে দেওয়া বাটারফ্লাই ইয়ং এন্থুজিয়াস্ট একটি সম্মানজনক পুরস্কার। ২০১৪ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল দুই ডজনেরও বেশি প্রজাতি আবিষ্কার করে এই পুরস্কার জিতে নেয়।
নাগরিক বিজ্ঞানী শাবু আনোয়ারের উদ্যোগে তৈরি বাটারফ্লাই বাংলাদেশ ১২ হাজার সদস্য সম্বলিত একটি ফেসবুক গ্রুপ। এ গ্রুপে গত এক দশকে ৫০ টিরও বেশি প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রজাপতি সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া আমাদের বাস্তুতন্ত্রের জন্য দারুণ সুফল বয়ে আনতে পারে। এরকম উদ্যোগ আমাদের প্রাণীবৈচিত্র্য সংরক্ষণ উদ্যোগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।