রাসেলস ভাইপার আতঙ্কে নির্বিচারে সাপ নিধন, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য, ব্যাহত হবে খাদ্য উৎপাদন
দেখতে ভয়ংকর হলেও প্রকৃতির অন্যতম উপকারী প্রাণী সাপ। ক্ষতিকর পোকামাকড় ও কৃষকের শত্রু ইঁদুর খেয়ে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় সাপকে বলা হয় কৃষকের বন্ধু। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাসেলস ভাইপার, যা স্থানীয়ভাবে চন্দ্রবোড়া নামে পরিচিত— সেটির আতঙ্কে চট্টগ্রামে নির্বিচারে সাপ নিধন করা হচ্ছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য ও কৃষি উৎপাদন হুমকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ অবস্থায়, আতঙ্ক প্রশমন ও জনসচেতনতা বাড়াতে মাঠে নেমেছে বন বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। বন বিভাগ নির্বিচারে সাপ নিধন না করার জন্য জনসাধারণকে সচেতন করার কর্মসূচি নিয়েছে।
সাপ গবেষকরাও অহেতুক সাপ না মারার অনুরোধ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, পরিবেশগত কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ মুহূর্তে চন্দ্রবোড়ার উপস্থিতি কিংবা বিস্তার লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে কাউকে সাপে কাটলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে
যেভাবে ছড়িয়েছে আতঙ্ক
সম্প্রতি মানিকগঞ্জ, যশোর ও ঢাকার ধামরাইয়ে চন্দ্রবোড়ার কামড়ে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর অন্তত একমাস ধরে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশে রাসেলস ভাইপারের ব্যাপক বিচরণের তথ্য নিয়ে অব্যাহত প্রচারণা চলছে।
সাপ গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, "বলা হচ্ছে, রাসেলস ভাইপার নিজ থেকে আক্রমণ করে কিংবা কামড় দিলে মৃত্যু নিশ্চিত— এগুলো একেবারেই অসত্য তথ্য। অন্যান্য সাপের মতো রাসেলস ভাইপারও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখলে তবেই আক্রমণ করে। আক্রমণের আগে হিস হিস শব্দ করে মানুষকে সতর্কও করে। বিশ্বে একমাত্র আফ্রিকান ব্ল্যাক মাম্বা আছে যেগুলো নিজ থেকে আক্রমণ করে। আর কোনো ভাইপারের বিষ এত শক্তিশালী নয় যে কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হবে।"
চট্টগ্রামে অস্তিত্ব নেই
সাপ গবেষক ড. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী জানান, গত ২০ বছরে পদ্মা নদীর পাড়ের ২৫ থেকে ২৬টি জেলায় চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপের সীমিত বিচরণ দেখা গেছে। তবে এসব জেলাতেও গণহারে নয়, দুয়েকটি এলাকার কৃষিজমি ও ঝোপঝাড়ে এ জাতের সাপ দেখা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত কারণে পদ্মা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত কিছু জেলায় এ সাপের দ্রুত বিস্তার ঘটছে।
তিনি বলেন, "কিন্তু চট্টগ্রাম-সিলেটের মতো পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে এ সাপের অস্তিত্ব নেই, ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ এখানকার পরিবেশগত প্রভাব চন্দ্রবোড়া সাপের বসবাসের অনুকূল নয়। চট্টগ্রামেও রাসেলস ভাইপার নিয়ে যে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, এটা একেবারেই ভ্রান্তিমূলক।"
কেন বিস্তার লাভ করছে রাসেলস ভাইপার
সাপ গবেষক ড. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, "চন্দ্রবোড়ার মূল খাদ্য ইঁদুর। সেজন্য ফসলের ক্ষেতে এই সাপের উপস্থিতি বেশি। কিন্তু চন্দ্রবোড়া শিকার করে যেসব প্রাণী— প্যাঁচা, বেজি, গুঁইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বনবিড়াল, মেছো বিড়াল, তিলা নাগ ঈগল, সারস, মদনটাক পাখি, শঙ্খিনী সাপ— এগুলো আমাদের প্রকৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে। এর ফলে চন্দ্রবোড়ার বিস্তার সহজ হয়েছে।"
তিনি বলেন, "এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও তাপমাত্রা ও বন্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে চন্দ্রবোড়া।"
হুমকিতে জীববৈচিত্র্য
আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, "চন্দ্রবোড়ার চেয়েও অন্তত ১০ গুণ বেশি বিষধর সাপ কেউটে-কোবরা আমাদের প্রকৃতিতে আছে। হঠাৎ রাসেলস ভাইপার নিয়ে সংঘবদ্ধ আতঙ্ক কেন ছড়ানো হচ্ছে, এটা বুঝতে পারছি না।"
তিনি জানিয়েছেন, অহেতুক বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার কারণে রাসেলস ভাইপার কিংবা অন্যান্য যেসব সাপ মেরে ফেলা হচ্ছে, সেগুলোর কারণে প্রকৃতির ভারসাম্য আবারো হুমকির মুখে পড়বে। সাপের সংখ্যা ও বিচরণ কমে গেলে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে দেশের কৃষি উৎপাদন। বিশেষ করে ধান ও গমের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
এছাড়াও খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে প্রকৃতি এবং ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়ায় এমন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই গবেষক।
রাসেলস ভাইপার সন্দেহে মারা পড়ছে নির্বিষ সাপ
আতঙ্কিত মানুষের হাতে জীবন হারানো সাপগুলোর মধ্য অনেকটা চন্দ্রবোড়া সাপের মত দেখতে নির্বিষ অজগর, ঘরগিন্নি, হেলে সাপ ও মৃদু বিষধর নোনাবোড়া এবং পাতি ফনি মনসা অন্যতম।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের ডেপুটি পাড়া এবং বড়হাতিয়া ইউনিয়নের ঘোনারমোড় এলাকায় শুক্রবার (২১ জুন) রাতে দুটি সাপ পিটিয়ে মারা হয়। আনোয়ারা উপজেলা সদরে একটি বসতঘরে একটি সাপ মেরে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ মৌলভীকাটা এলাকায় একটি সাপ পিটিয়ে মারে আতঙ্কিত জনতা। পরে এসব সাপ মারার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আতঙ্কে নির্বিচারে সাপ নিধনের বিষয়টি নিশ্চিত করে বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য বলেন, লোহাগাড়ায় রাসেলস ভাইপার ভেবে যে দুটি সাপ মারা হয়েছে সেগুলো অজগর সাপ। একটি বার্মিজ পাইথন, আরেকটি গোলবাহার প্রজাতির অজগর। রামুতে মেরে ফেলা সাপটিও বার্মিজ পাইথন। আনোয়ারায় মেরে ফেলা সাপের ছবি স্পষ্ট বোঝা না গেলেও, রাসেলস ভাইপার না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
তিনি বলেন, "এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য অথবা পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে আমরা।"
চট্টগ্রামের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রধান গবেষক প্রফেসর ড. অনিরুদ্ধ ঘোষ টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রামে অনেক পুরোনো রেকর্ডে রাসেলস ভাইপারের অস্তিত্ব থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ সাপ দেখা যাওয়া বা এর দংশনে কারো মৃত্যুর কোন রেকর্ড নেই।
বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনম চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো রোগীর ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর জানিয়ে রোগীদের যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন এই গবেষক।
দেশের সব জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত এন্টিভেনমের মজুত আছে জানিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সাধারণ জনগণকে সচেতন হওয়া পরামর্শ দিয়েছেন ড. অনিরুদ্ধ ঘোষ।