বাস্তবের স্কুইড গেম: যেভাবে জোর করে বন্দি ও সংখ্যালঘুদের অঙ্গ-অপসারণ করে চীন
মুক্তির এক মাসের মাথায় নেটফ্লিক্সে এযাবৎকালের সবচেয়ে বেশি দেখা আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ওয়েব সিরিজ 'স্কুইড গেম'।
৯০টির বেশি দেশের দর্শকদের মুগ্ধ করেছে ডিসটোপিয়ান এই থ্রিলার। সিরিজে নগদ অর্থ জয়ের আশায় অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরা পরস্পরের সঙ্গে মৃত্যুর খেলায় জড়িয়ে পড়ে।
কল্পকাহিনী হলেও বাস্তব জীবনের সঙ্গে রূপক হিসেবে এই কাহিনীর তুলনা করেছেন অনেক সমালোচক। এদিকে, স্কুইড গেমের গল্পের একটি অংশজুড়ে আছে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপসারণ ও বিক্রির দৃশ্য। শিহরণ জাগানোর মতো বিষয় হলেও এই কাহিনী কিন্তু পুরোপুরি অবাস্তব নয়।
ঘটনার কেন্দ্রস্থল এশিয়ারই আরেক দেশ চীন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিবছর প্রায় এক লাখ রাষ্ট্রদোহী, সংখ্যালঘু ও রাজনৈতিক কারাবন্দির হৃদপিণ্ড, কিডনি, লিভার এবং কর্নিয়া অপসারণ করে থাকে। মানবাধিকার সংস্থাসমূহের দাবি অনুসারে, সরকারি নির্দেশনায় চালিত 'কিল টু অর্ডারে'র সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানব অঙ্গ-পাচারকারীদের বিশাল এক নেটওয়ার্ক।
কিন্তু, তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে অক্ষম, কেননা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) একদলীয় রাষ্ট্রের 'অপর্যাপ্ত এবং বিভ্রান্তিকর' হাসপাতাল নথি ও তথ্য বিনাপ্রশ্নে গ্রহণ করতে বাধ্য।
স্কুইড গেম মুক্তি পাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, চীন নির্দিষ্ট জাতিগত, ভাষাগত কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করছে। তবে, বেইজিং এই রাষ্ট্রচালিত অঙ্গ-অপসারণ প্রকল্পের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের নয়জন বিশেষ প্রতিবেদক এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষদর্শীদের অনুসন্ধান, সাক্ষ্যগ্রহণ এবং চীনের সন্দেহজনকহারে উচ্চমাত্রার অঙ্গদাতার পরিসংখ্যান ঘেটে ভয়ঙ্কর এই অঙ্গ-পাচার বাজারের ওপর নতুন করে আলোকপাত করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, "জাতিসংঘের মানবাধিকার রক্ষাকারী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তারা চীনের ডিটেনশন ক্যাম্পে ফালুন গঙ অনুসারী, উইঘুর, তিব্বতি, মুসলিম ও খ্রিস্টানসহ সংখ্যালঘুদের 'অঙ্গ-অপসারণের' অভিযোগগুলো নিয়ে ভীষণভাবে শঙ্কিত।"
"সম্মতি ছাড়াই জোর করে আটককৃতদের রক্ত ও অঙ্গ পরীক্ষা যেমন আলট্রাসাউন্ড, এক্সরে ইত্যাদি পরিচালনা করার নির্ভরযোগ্য তথ্য পেয়েছেন বিশেষজ্ঞ দল। সকল কারাবন্দিদের ক্ষেত্রে এসব পরীক্ষা করানো হয় না।"
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, "মেডিকেল পরীক্ষার এসব ফলাফল অঙ্গদানের জন্য তৈরি 'লিভিং অর্গান সোর্সে'র তালিকায় নথিভুক্ত করা হয়।"
"অভিযোগ অনুসারে, বন্দিদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি নেওয়া অঙ্গগুলোর মধ্যে আছে হৃদপিণ্ড, কিডনি, লিভার, কর্নিয়া এবং লিভারের কিছু অংশ (অপেক্ষাকৃত কম)।"
অঙ্গ-পাচারের এই প্রক্রিয়ায় সঙ্গে সার্জন, এনেস্থেটিস্টসহ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি খাতের কর্মকর্তারাও যুক্ত।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, "কারাবন্দিদের অনেকে নিজেদের বিশ্বাস ত্যাগ করতে সম্মত না হলে বা পুলিশকে সহযোগিতা করতে রাজি না হলে, তাদের হত্যা এবং অঙ্গ-অপসারণের হুমকি দেয় পুলিশ।"
চীনের অঙ্গ-প্রতিস্থাপন ব্যবস্থার সবচেয়ে সন্দেহজনক বিষয়টি হলো অঙ্গ-প্রত্যাশীরা নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে সার্জারির জন্য বুকিং দিতে পারেন।
স্বেচ্ছায় মরণোত্তর বা অন্যান্য অঙ্গদান সমাজ মহৎ কর্ম হিসেবেই দেখে। কিন্তু, অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থায় চীনের মতো সক্রিয় প্রতিস্থাপন দেখা যায় না। কেননা, মরণোত্তর দানের ক্ষেত্রে অঙ্গ-দাতার মৃত্যু কবে হবে, তা চিকিৎসকরা আগে থেকে বলতে পারেন না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত প্রক্রিয়ায়, প্রতিস্থাপনের তালিকায় থাকা রোগীদের মধ্যে যার সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিস্থাপন প্রয়োজন ও যিনি হাসপাতালে সহজেই আসতে পারবেন, এমন রোগীকেই মিলে যাওয়া মৃত ব্যক্তির অঙ্গদান করা হয়।
বহু অঙ্গ-প্রত্যাশী ব্যক্তিকে প্রতিস্থাপনের জন্য বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়। কেননা, একই রক্তের গ্রুপ এবং একই সাইজের অঙ্গ এতসব মিল সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।
২০১৯ সালে চীনের স্বাধীন ট্রাইবুনাল শুনানিতে হাসপাতালগুলোর গোপন ফোনকল থেকে দেখা যায় যে, রোগীরা খুব দ্রুতই 'কিল টু অর্ডার' ব্যবস্থায় প্রতিস্থাপন সার্জারি করাতে পারেন।
চীনের শ্যানডং প্রদেশের সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসক ড. ফেং জেংডং তদন্তকারীদের ফোনে বলেন যে, 'প্রতি মাসে' হাসপাতালে 'অসংখ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ' আসে।
চীনের এই ভয়ংকর রাষ্ট্র-চালিত অঙ্গ-পাচারের কয়েক দশকের প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রতিস্থাপনের ভুল তথ্য উপস্থাপন করে বেইজিং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য ধামাচাপা দিতে সমর্থ হয়েছে।
জাতিসংঘের বিবৃতিকে চীন বারবার 'বানোয়াট' ও 'মানহানিকর' তথ্য বলে আখ্যা দিয়েছে।
এমনকি, সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চীনা সরকার এসব সাক্ষ্যদাতা স্রেফ 'অভিনয়' করেন বলে ব্যাখ্যা দিয়ে আসছে।
- সূত্র: ডেইলি মেইল