কে-পপ ও কে-ড্রামার হাত ধরে দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবে সাংস্কৃতিক পরাশক্তি হয়ে উঠল
১৪ বছর বয়সে কাকতালীয়ভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার রমকম (রোমান্টিক কমেডি) সিরিজ 'ফুল হাউস' দেখার সুযোগ হয় ইভান ব্যারিঙ্গারের। দুজন অপরিচিত মানুষের বাধ্য হয়ে এক বাড়িতে ভাগাভাগি করে থাকার গল্প দেখানো হয়েছে এ সিরিজে।
ইভাব প্রথমে ভেবেছিলেন, এটি ১৯৮০-র দশকের একই নামের জনপ্রিয় মার্কিন সিটকমের এশীয় সংস্করণ। কিন্তু তৃতীয় এপিসোডের মাঝামাঝি এসেই তিনি বুঝতে পারেন, দুটি শোয়ের মাঝে নাম ছাড়া আর কোনো মিল নেই। তবে ততক্ষণে তিনি কোরিয়ান সিরিজটিতে বুঁদ হয়ে গেছেন।
দৈবক্রমে দেখা সেই সিরিজই ইভানের জীবন পাল্টে দেয়। এর বারো বছর পর ইভান এখন দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মরত একজন ইংরেজি শিক্ষক। এদেশে কাজ করতে তার খুব ভালো লাগে। তিনি বলেন, 'আমি এখন কে-ড্রামায় দেখা সবগুলো খাবার খেতে পারছি। কোরিয়ান ভাষা শেখার জন্য যেসব কে-পপ শিল্পীদের গান শুনেছি, সরাসরি তাদের কনসার্টেও গিয়েছি।'
২০১২ সালে ইভান যখন প্রথম 'ফুল হাউস' দেখেছিলেন, তখন দক্ষিণ কোরিয়ার বিনোদন জগৎ বিশ্বমঞ্চে বলতে গেলে অপরিচিতই ছিল। তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোরিয়ার বিনোদন জগতের একমাত্র জনপ্রিয় জিনিস ছিল সাইয়ের 'গ্যাংনাম স্টাইল'।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কোরিয়ান বিনোদন জগতের ভক্তের সংখ্যা ২২ কোটি ছাড়িয়েছে—যা দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যার চারগুণ। নেটফ্লিক্সের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় শো 'স্কুইড গেম' দ্বিতীয় সিজন নিয়ে ফিরেছে।
কোরিয়ার বিনোদন জগত সাফল্যের এই পর্যায়ে পৌঁছাল কী করে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথাকথিত এই 'কে-ওয়েভ' বা কোরিয়ান সংস্কৃতির বিশ্বজয় সম্ভব হয়েছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের উত্থান এবং আমেরিকান-স্টাইলের প্রোডাকশন মানের মিশেলে। আর কোরিয়ার বিনোদন জগত—কে-পপ ও কে-ড্রামা—এই সুযোগ লুফে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতই ছিল।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিটিএস ও ব্ল্যাকপিংক এখন পরিচিত নাম। দুবাই থেকে ভারত, সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বহু দেশের দর্শক কে-ড্রামার প্রেমে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছে।
এসব কোরিয়ান কনটেন্ট—যার মধ্যে ভিডিও গেমও আছে—বিদেশে বিক্রি করে প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে।
গত মাসে ৫৩ বছর বয়সি কবি ও ঔপন্যাসিক হান কাং সাহিত্যে নোবেল জেতার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন মিম। এই মিমগুলোতে বলা হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার 'সংস্কৃতির বিজয়'-এর কথা।
এমনকি অনেকেই রসিকতা করে বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম কু-র স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিম কু লিখেছিলেন, তিনি চান কোরিয়া পেশিশক্তির নয়, সংস্কৃতির জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, বহু বছর ধরে তার এই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে গেছে জাতিটি।
সাফল্যের পথরেখা
দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক শাসনের অবসান ঘটে ১৯৮৭ সালে। এরপর সেন্সরশিপ শিথিল হয়, গজিয়ে ওঠে অনেকগুলো টিভি চ্যানেল। ইউনিভার্সিটি অব বাফেলোর কোরিয়ান ফিল্ম স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক হাই সিউং চুং বলেন, এ সময় এক প্রজন্মের নির্মাতারা হলিউড ও হিপ-হপকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে বেড়ে ওঠেন।
একই সময়ে কোরিয়া অর্থনৈতিকভাবেও দ্রুত সমৃদ্ধি লাভ করে। গাড়ি ও ইলেকট্রনিক্স রপ্তানি থেকে বিপুল আয় হয়। এই অর্থ দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বা চ্যাবল-দের হাত ধরে ফিল্ম ও টিভি প্রোডাকশনে লগ্নি করা হয়। এ টাকার সুবাদে কোরিয়ার ফিল্ম ও টিভি প্রোডাকশনের মান হলিউডের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে আসে।
অধ্যাপক চুং বলেন, প্রোডাকশন থেকে সিনেমা হল পর্যন্ত বিনোদন শিল্পের বেশিরভাগ মালিকানা নিয়ে নিয়েছিল চ্যাবলরা। ফলে তারা বড় বাজেটের সিনেমা বানাতে পিছপা হয়নি, লোকসানের ঝুঁকিও গায়ে মাখেনি।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কে-পপ দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই সময়ে এইচওটি ও শিনহুয়া-র মতো গ্রুপগুলো সাফল্য পায়।
এই সাফল্য দেখে কে-পপ এজেন্সিগুলো জাপানের কঠোর তারকা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করে।
তারা কমবয়সি প্রতিভাবানদের খুঁজে বের করে। সাধারণত কিশোর বয়সি শিল্পীই খুঁজে বের করে এরা। তাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে সই করে এজেন্সিগুলো। এরপর কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের 'নিখুঁত' আইডলে পরিণত করা হয়—যাদের ইমেজ থাকে ঝকঝকে পরিষ্কার এবং জনসমক্ষে প্রতিটি আচরণ থাকে চুলচেরা হিসাব করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়ে কে-পপকেই বদলে দেয়, নতুন নতুন আইডল তৈরি করতে থাকে।
২০০০-এর দশকে কে-পপ ও কোরিয়ান টিভি শোগুলো পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তবে এই সংস্কৃতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর হাত ধরে। হাতে স্মার্টফোন আছে, এমন প্রায় সবার জীবনেও ঢুকে পড়ে কোরিয়ান বিনোদন।
এই সময়ই চালকের আসনে বসে যায় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর রিকমেন্ডেশন ইঞ্জিন। দর্শকদের এক ঘরানার শো থেকে আরেক শোতে—কিছু ক্ষেত্রে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে আরেক প্ল্যাটফর্মে—টেনে নেওয়ার এই অ্যালগরিদম নতুন ভক্তদের কোরিয়ান সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। গড়ে তোলে নতুন ভক্ত-সমাজ।
অচেনা, তবু এত চেনা
ইভান ব্যারিঙ্গার জানান, তিনি 'ফুল হাউস'-এর ১৬টি এক ঘণ্টার এপিসোড টানা দেখে ফেলেছিলেন। ঝগড়াঝাঁটি থেকে প্রণয়—শো-তে যেভাবে দুজন মানুষের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠা দেখানো হয়, তা খুব পছন্দ হয়েছিল তার। আমেরিকান শোগুলোতে এমনটা দেখা যায় না।
তিনি বলেন, 'আমি প্রতিটি সাংস্কৃতিক পার্থক্য দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম—যেমন, খেয়াল করলাম, তারা ঘরে জুতো পরে না।'
ইভান এরপর নেটফ্লিক্সের সাজেশন অনুযায়ী আরও কোরিয়ান রমকম দেখা শুরু করেন। কদিন বাদেই তিনি শোগুলোর সাউন্ডট্র্যাক শুনতে থাকেন, তার হাত ধরেই কে-পপের প্রতি আকৃষ্ট হন।
এখন তিনি 'ভ্যারাইটি শো'গুলোও দেখেন, যেখানে কমেডিয়ানরা একসঙ্গে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেন।
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর রিকমেন্ডেশন ভক্তদের কোরিয়ান বিনোদনের এক মনোমুগ্ধকর জগতে নিয়ে যায়। সেই জগত একদিকে যেমন নতুন ও অচেনা, অন্যদিকে খুব চেনাও। এই জগতে খাবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রথমবারের মতো দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েই পর্দায় অদেখা সেই বিখ্যাত খাবার কিমচি স্টু-র খোঁজ করেন মেরি গেডা। বিভিন্ন সিরিজ ও শো-তে প্রিয় তারকাদের জস্রবার এই খাবার খেতে দেখেছেন তিনি।
সেই খাবার চাখার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে মেরি বলেন, '[খেতে খেতে] আমি রীতিমতো কাঁদছিলাম। জিনিসটা এতটাই ঝাল ছিল!'
তিনি ভাবছিলেন, "আমি কেন এটা অর্ডার করলাম? তারা তো এত সহজে খায় শোগুলোতে।"
ফ্রান্সের উঠতি অভিনেত্রী মেরি এখন সিউলে থাকেন। প্রথমে তিনি কে-পপের ভক্ত ছিলেন, এরপর কে-ড্রামার দুনিয়ায় ডুবে গিয়ে কোরিয়ান ভাষাটাও শিখে ফেলেন।
তিনি ইতিমধ্যে কিছু শো-তে ক্যামিও চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। মেরি বলেন, 'আমার ভাগ্য ভালো, আর দেশটাকে খুব ভালোবাসি।'
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি মেরির আকর্ষণে বড় ভূমিকা রেখেছে খাবার। কারণ কে-ড্রামায় তিনি হরেক পদের খাবার দেখেছেন। কে-ড্রামায় চরিত্রদের খাবারের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলতে দেখে বিষয়টিকে তার কাছে খুব আপন ও চেনা মনে হয়েছে।
তবে রোমান্সের টানও কিন্তু আছে। এই টানেই দক্ষিণ কোরিয়ায় এসেছেন বেলজিয়ামের মেয়ে মেরি নামুর। কোরিয়া সফরের পর হুট করেই কে-ড্রামা দেখা শুরু করেছিলেন তিনি। সেই শুরু, রপর আর থামতে পারেননি। কারণ? 'সুদর্শন কোরিয়ান পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম,' জানালেন মেরি নামুর।
তিনি বলেন, '[কে-ড্রামাগুলো] অসম্ভব প্রেমের গল্প নিয়ে তৈরি—একজন অতি ধনী ছেলের সঙ্গে সাধারণত গরিব মেয়ের প্রেমের গল্প। আর সেই ধনী ছেলে মেয়েটিকে বাঁচাতে আসে। এই গল্পগুলো রীতিমতো স্বপ্ন বুনে দেয়।'
তবে এই শোগুলোর সিংহভাগই লিখছেন কোরিয়ান নারীরাই। কাজেই তাদের কল্পনা ও ফ্যান্টাসি দিয়ে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য নারীর মন জয় করছে।
মেরি বলেন, সিউলে তাকে 'ভদ্রমহিলার মতো সম্মান' দেওয়া হয়েছে, যা তিনি বহুদিন ধরে পাইনি। কিন্তু তার ডেটিংয়ের অভিজ্ঞতাটা ঠিক প্রত্যাশামাফিক হয়নি।
তিনি বলেন, 'আমি শুধু গৃহিণী হয়ে থাকতে চাই না। আমি কাজ চালিয়ে যেতে চাই। স্বাধীন থাকতে চাই। বিয়ে করলে বা সম্পর্কে থাকলেও আমি বান্ধবীদের সঙ্গে ক্লাবে যেতে চাই। কিন্তু এখানে অনেক ছেলেই তা চায় না।'
অধ্যাপক চুং বলেন, আন্তর্জাতিক ভক্তরা প্রায়ই নিজেদের সমাজে হতাশ হয়ে বিকল্প জগতের সন্ধান করেন।
কে-ড্রামাগুলোর পরিপাটি প্রেম; সুদর্শন, যত্নশীল, ভদ্র, সাহসী নায়ক—এসব নারীদের মন কাড়ছে। আমেরিকান বিনোদনের অতিরিক্ত যৌনাবেদনময় উপস্থাপনা থেকে মুখ ফিরিয়ে তারা কে-ড্রামার দিকে ঝুঁকছেন।
এছাড়া কোরিয়ান চলচ্চিত্র ও শোগুলোতে সামাজিক বৈষম্য, পুঁজিবাদ ও ধনী-গরিবের ফারাক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। 'প্যারাসাইট' ও 'স্কুইড গেম'-এ এমব বিষয়বস্তু দেখা গেছে। এসব সিনেমা ও শো বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের মোহভঙ্গ হওয়া এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যে হতাশ হয়ে পড়া দর্শকদের নজর কাড়ল।
বৈশ্বিক দর্শকদের মন জয় করতে গিয়ে কোরিয়ান বিনোদন জগতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। কে-পপে যেভাবে ইংরেজি লিরিকের ব্যবহার বাড়ছে, তা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।
এছাড়া এই শিল্পের অন্ধকার দিকগুলোও এখন আলোচনায় আসছে। যেমন, তারকাদের ওপর সবদিক দিয়ে নিখুঁত হওয়ার চাপ এবং এই ইন্ডাস্ট্রির চরম প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ব্লকবাস্টার শোগুলোর নির্মাতারা অভিযোগ করেছেন, তাদেরকে যথাযথ পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না এবং তারা শোষণের শিকার।