বিশ্ব কেন রাশিয়ার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে সংশয়ী
মাত্র দুই মাসেরও কম সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর নিজেদের উদ্ভাবিত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ব্যবহার অনুমোদন করেছে রাশিয়া। আজ মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ অনুমোদনের ঘোষণা দেন, যা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। তারা বলছেন, তড়িঘড়ি করে অনুমোদিত ভ্যাকসিনটিতে প্রচলিত দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষার তথ্য অনুপস্থিত থাকায়- এর উপর আস্থা রাখা যায় না।
রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল মহামারি সৃষ্ট রোগ মোকাবিলায় অন্য সবার আগে ভ্যাকসিন বাজারে আনা। সেদিক থেকে পশ্চিমা সব দেশ এবং চীনকে তারা পেছেন ফেলতে সমর্থ হয়েছে একথা ঠিক। কিন্তু, যে প্রক্রিয়ায় এত দ্রুততার সঙ্গে প্রতিষেধক উন্নয়ন এবং অনুমোদনের প্রক্রিয়া করা হয়- সেটাই ভীত-সন্ত্রস্ত করেছে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের।
এমনকি এপর্যন্ত ভ্যাকসিনের গুণাগুণ ব্যাপক গণ-পরীক্ষাও করা হয়নি। অজানা কার্যকারিতা এবং সম্ভাব্য পার্শঃপ্রতিক্রিয়ার তথ্যও। তাই রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে তাড়াহুড়োকে টিকা ও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞরা 'দায়িত্বজ্ঞানহীন' পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন।
বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া:
ব্রিটেনের ওয়ারউইক বিজনেস স্কুলের ওষুধ গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী আয়ফার আলী বলেন, ''সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে রাশিয়া সম্পূর্ণ একটি জনসংখ্যার উপর ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। আর খুব দ্রুত অনুমোদনের অর্থ হলো; ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর প্রাপ্ত পার্শঃপ্রতিক্রিয়ার তথ্যও ঠিকঠাক বিশ্লেষণের সময় ও সুযোগ মেলেনি।''
তিনি সতর্ক করেন, ''পরীক্ষাধীন প্রতিষেধক গ্রহণের স্বাস্থ্যগত প্রভাব বিরল হলেও, এটি মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।''
তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেন, মস্কোর গেমলেয়া ইনস্টিটিউডের তৈরি প্রতিষেধকটি 'সম্পূর্ণ নিরাপদ' এবং 'ফলদায়ক'। সকলকে আশ্বস্ত করতে তার এক মেয়ের দেহেও এটি প্রয়োগ করার কথা উল্লেখ করেন পুতিন।
''আমি জানি এটি খুবই কার্যকরভাবে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। আমি আবারো বলছি, দরকারি সমস্ত সুরক্ষা পরীক্ষার পরই এর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে'' রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত ভাষণে এমন দাবিই করেছেন রুশ রাষ্ট্রপতি।
তবে একে ''অবিবেচক এবং মূর্খতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত' বলে উল্লেখ করেন- লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের জিনতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কোইস ব্যালোঁজ।
তিনি বলেন, ''সঠিক প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করা হয়নি, এমন ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগ চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবৈধ ও অবিবেচক কাজ। এর ফলে রাশিয়ার জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। কারণ, দেশটির মানুষ ভ্যাকসিনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় পড়তে চলেছেন। এমনটা হলে, তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্যও বিপর্যয় ডেকে আনবে। বিশেষ করে, জনসাধারণের মাঝে ভ্যাকসিন গ্রহণের ভীতি বাড়াবে।''
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি:
এদিকে রাশিয়ার ভ্যাকসিন অনুমোদনের পরই দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে, ভ্যাকসিন পরীক্ষা ও উন্নয়নের প্রতিটি ধাপে সুরক্ষাবিধি নিশ্চিত করা এবং নির্ভরযোগ্য ফলাফলের তথ্য আছে- শুধুমাত্র এমন ভ্যাকসিনকেই সংস্থাটি অনুমোদন দিয়ে থাকে।
জাতিসংঘের বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থাটির মুখপাত্র তারিক জেসারাভিচ বলেন, রাশিয়ার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখছি। ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য প্রাক-যোগ্যতার অনুমোদন পেতে তারা আমাদের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছেন।''
তবে তিনি এও জানান যে, ''যেকোনো ভ্যাকসিনকে প্রাক-যোগ্যতার ছাড়পত্র দেওয়ার আগে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সমস্ত প্রকার ঝুঁকি নিষ্ক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এমন নিশ্চয়তা চায়। সেই সংক্রান্ত তথ্য হাতে আসার পরই তা নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে হু।
তবে আদৌ রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি হু'র ছাড়পত্র পাবে কিনা- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। গত সপ্তাহেই হু' রাশিয়াকে সতর্ক করে বলে, দেশটি যেন ভ্যাকসিন পরীক্ষার প্রচলিত পথ থেকে সরে না আসে।
রাশিয়া সেই সতর্কবাণী কানে তোলেনি।
করা হয়নি তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা:
প্রার্থী ভ্যাকসিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শেষ স্তর হিসেবে ধরা হয় তৃতীয় ধাপের পরীক্ষাকে। সাধারণত এ ধরনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল দশ সহস্রাধিক স্বেচ্ছাসেবীর দেহে চালানো হয়। অনুমোদনের আগে প্রতিষেধকটি সুরক্ষিত এবং সত্যিই কাজ করবে কিনা; তা প্রমাণের একমাত্র উপায় তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা।
অথচ রাশিয়ার অনুমোদিত ভ্যাকসিনটি দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ হওয়া মাত্রই অনুমোদন করেছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বড় পরিসরে তৃতীয় স্তরের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ না করেই এ সিদ্ধান্ত নেয় রুশ কর্তৃপক্ষ।
তৃতীয় স্তরের পরীক্ষাতে কিছু ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর দেহে প্রার্থী ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে দেখা হয়; জীবাণু প্রতিরোধে প্রতিষেধকটি কতটুকু সফল হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষগুলোর কাছ থেকে অনুমোদন লাভের জন্য যা আবশ্যক একটি শর্ত।
অথচ রাশিয়া নিরাপদ এ নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করেনি।
রাশিয়ার ভ্যাকসিন প্রক্রিয়া নিয়ে গত সপ্তাহেই মুখ খুলেছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রধান জনস্বাস্থ্য উপদেষ্টা এবং যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডক্টর অ্যান্থনি ফসি।
এসময় তিনি বলেন, চীন বা রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়ার আগে তা ব্যাপক পরীক্ষা করবে- বলে আমি আশা করি। কারণ, কার্যকর এবং বিতরণের জন্য প্রস্তুত প্রতিষেধক তৈরির মিথ্যে দাবি করলে, দিনশেষে তা সকলের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে।
- সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া ও রয়টার্স