বয়স বাড়লেও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা থাকবে একই
"আমরা সবসময় হৃদপিন্ড বা অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার যোগসূত্র খুঁজি। কিন্তু সম্প্রতি আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে জীবনযাত্রার ওপর মস্তিষ্ককের সুস্থতাও অনেকাংশে নির্ভরশীল," জানালেন এমরি ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনে নিউরোসার্জন অনুশীলন করা শীর্ষস্থানীয় স্নায়ুবিদ ড. সঞ্জয় গুপ্ত ।
এখানে তিনি তার প্রিয় কিছু টিপস এবং কৌশল শেয়ার করেছেন — আপনার শরীর, আপনার খাবার এবং আপনার মানসিক শক্তিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে মস্তিষ্ককে বছরের পর বছর তীক্ষ্ণ রাখা যাবে তাই উঠে এসেছে তার জবানিতে-
আলস্য বা নিষ্ক্রিয়তা রোগ ছাড়া কিছুই না
" যখনই আমার বসার প্রয়োজন হয়, আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমার কি এখনই বসা প্রয়োজন?"
" হ্যাঁ দৈনন্দিন জীবনের এই ছোট ছোট সচলতা দীর্ঘমেয়াদে আপনার মস্তিষ্কের জন্য এমন উপকার বয়ে আনবে যা আপনি জিমে গিয়েও পাবেন না। আমার অফিসে তো কোন চেয়ারই নেই", ড. গুপ্ত বললেন।
"যদি মিটিং, ফোনে কথা বলা এবং অন্যান্য টুকটাক কার্যক্রম দাঁড়িয়ে বা হেঁটে হেঁটে করা সম্ভব তবে তাই করুন। শরীরচর্চাকে যতটুকু না প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচনা করবেন তার চাইতে আলস্যকে অনেক বেশি মাত্রায় রোগ হিসেবে গণ্য করা শুরু করুন", জানান ড. গুপ্ত।
শরীরচর্চার প্রস্তুতি থাকুক সর্বত্র, সবসময়
শরীরচর্চা মস্তিষ্কে রক্তের প্রবাহ বজায় রাখে, প্রদাহ প্রশমনে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্কে নতুন নতুন কোষ গঠনে সাহায্য করে। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট শরীরচর্চার পিছনে ব্যয় করবেন।
" আমি যেখানেই থাকি না কেন, দৌড়ানোর জুতা, সুইমস্যুট, রেসিস্ট্যান্ট ব্যান্ডসের এর মত শরীরচর্চার কিছু উপকরণ সাথে রাখি", মজা করে জানান ড. গুপ্ত ।
হাঁটুন, কথা বলুন, প্রিয় মানুষটিকে আঁকড়ে ধরুন
প্রিয় বন্ধুটির সাথে একান্তে কিছুটা সময় বের করে হাঁটুন। সমস্যার কথা ভাগাভাগি করুন । মস্তিষ্ক এখানে তিনটি উপায়ে সক্রিয়- চলন, সামাজিকীকরণ এবং ধকল থেকে মুক্তি। একসাথে যখন মস্তিষ্ক এই তিনটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তখন আপনার অজান্তেই মস্তিষ্ক তার পরিশোধনের কাজ চালাচ্ছে।
" আমি নির্জনে একাকী সময় উপভোগ করতেই পছন্দ করতাম। কিন্তু বন্ধুদের সাথে মিলে হাঁটার ফলে আমার মস্তিষ্ক উপকৃত হয়েছে। দীর্ঘদিনের চর্চার মাধ্যমে আমার মত আপনি্ব এই পরিবর্তনটা নিজেই বুঝতে পারবেন", বললেন ড. গুপ্ত।
সঠিক জ্বালানীর সঞ্চার করুন- মনোযোগ আরেকটু বাড়ুক
মস্তিষ্ককে রক্ষা করতে রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা লাগবে। অতিরিক্ত চিনি যেন বিষ; এর ফলে নিউরনের কোষগুলো মরে যেতে থাকে এবং জ্ঞানবুদ্ধিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ে।
'ব্রেইন হেলথ ফ্রেমওয়ার্ক' শীর্ষক তালিকায় ড. গুপ্ত তুলে ধরেছেন মস্তিষ্কের সুরক্ষায় কার্যকর কিছু খাবারের কথা। একে তিনি তিনটি ভাগে দেখিয়েছেন-
এ লিস্ট- (এসব খেতে হবে নিয়মিত)- তাজা সবুজ শাকসবজি, বেরি, মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাবার (তেলে যেন ভাজা না হয়), স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যেমন- এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, এভোকাডো, ডিম এবং বাদাম ও বীজ
বি লিস্ট- (নিয়মিত না হলেও খাদ্য তালিকায় মাঝে মাঝে যেন উপস্থিত থাকে)- সিম ও শুঁটি জাতীয় সবজি, গোটা ফল, লো সুগার ও লো ফ্যাট ডেইরি যেমন- টকদই ও কটেজ চিজ, পোল্ট্রি এবং গোটাশস্য
সি লিস্ট- (এসব আহারে জিভ থাকবে নিয়ন্ত্রণে)- ভাজাপোড়া, পেস্ট্রি ও অন্যান্য চিনিযুক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার, লাল মাংসজাত খাদ্য - বেকন, সালামি, হট ডগস, বিফ, ল্যাম্ব, পর্কের মত লাল মাংস, চিজ ও মাখনের মত স্যাচুরেটেড ফ্যাট সম্পন্ন খাবার এবং লবণ (পরিবর্তে লেবুর রস, মসলা ও ভিনেগারের ব্যবহার বাড়ান)
মূল খাবার গ্রহণ করুন, পরিপূরক বা সাপ্লিমেন্টের ওপর নির্ভর্রতা নয়
ড. গুপ্ত সাপ্লিমেন্টস এড়ানোর পরামর্শ দেন। প্রকৃত খাদ্যে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের মত উপাদান থাকে যা দেহের সাথে মিশে গিয়ে নিজে যেমন পুষ্টিতে ভূমিকা রাখে তেমনি অন্যান্য পুষ্টি উপাদানগুলোকেও তাদের কাজ করতে সহায়তা করে। মাছের তেলের ক্যাপসুল না কিনে আস্ত মাছ খাবার অভ্যাস করুন।
ক্ষুধা নাকি তৃষ্ণা- আগে সেটি বুঝুন
"ক্ষুধা পেয়েছে নাকি তৃষ্ণা তা আমরা প্রায়ই বুঝে উঠতে পারিনা"। " মাঝে মাঝে শুধু পানির অভাবেই আমাদের সকল এনার্জি নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং মস্তিষ্ক তার ছন্দ হারিয়ে ফেলে," জানান ড. গুপ্ত।
আমাদের মস্তিষ্ক আসলে পানির উপর ভিত্তি করেই নির্মিত এবং যখন শরীরের পানি নিঃশেষিত হয়ে যায় তখন কিন্তু তা আমাদের স্মৃতিশক্তি, গতি এবং চিন্তার ক্ষমতাতেও প্রভাব ফেলে। শরীরে পানির অভাব হতে দেবেন না।
বন্ধুদের জন্য সময় বের করুন
"আমার বন্ধুরা, আমার স্ত্রীর বন্ধুরা, আমার তিন কন্যার বন্ধুরা- এদের সবাইকে নিয়ে আমার বাড়ি ভরা থাকে। মানুষের সাহচর্য আমার ভাল লাগে। মানুষের কাছাকাছি এলে আমার মস্তিষ্কের সমস্ত অংশ সক্রিয় হয়ে পড়ে, আমি অন্যদের বোঝার চেষ্টা করি, তাদেরও সুযোগ দেই আমার জীবন বোঝার", সামাজিক ক্রিয়াকলাপের সাথে মস্তিষ্কের সুস্থতার সম্পর্ক নিয়ে বলে যান ড. গুপ্ত।
গবেষণা বলে যারা অনেক মানুষের মাঝে, সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর মাঝে থাকে তাদের আলঝেইমারের মত অনেক স্নায়ুরোগের ঝুঁকি কমে আসে।
বুদবুদীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে দেখুন
ড. গুপ্ত বিশ্লেষণী মেডিটেশনের চর্চা করেন, এর কৌশল তিনি শেখেন স্বয়ং দালাই লামার কাছ থেকে। চোখ বন্ধ করে একান্তে আপনার একটি সমস্যার কথা চিন্তা করুন যা থেকে উত্তরণের কোন পথই খুঁজে পাচ্ছেন না, এরপর মনের কল্পনায় এটিকে অন্যান্য সব কিছু থেকে আলাদা করে একটি বড়, স্বচ্ছ বুদবুদের ভেতর প্রতিস্থাপন করুন।
আপনার আবেগ থেকে ঐ সমস্যাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যৌক্তিকভাবে আপনার মন তা সমাধানে আপনাকে সহায়তা করবে। সার্বিকভাবে এই চর্চা মস্তিষ্কের সুস্থতাতেও অবদান রাখে।
মস্তিষ্কের জন্য 'ইকিগাই'
জাপানি 'ইকিগাই' শব্দটির অর্থ হলো, 'জীবনের উদ্দেশ্য'। এ ধারণাটির উদ্ভব জাপানের ওকিনাওয়া গ্রামে। মজার ব্যাপার হলো সেখানকার মানুষের মাঝে স্মৃতিভ্রংশতার হার নাকি তুলনামূলকভাবে কম।
ড গুপ্ত বলেন, " আপনি যখন কোন কিছুর সাথে উদ্দেশ্য জুড়ে দেন তখন তা অন্যরকম শক্তি তৈরি করে"।
জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাবার চেষ্টা করুন; শুধু মানসিকভাবেই নয়, স্নায়বিকভাবেও এটি আপনাকে শক্তিশালী অনুভব করাবে।
"এটা আর দশটা কাজের মত সাধারণ - আপনি হয়ত কোন কিছুতে আগ্রহী, এরপর আপনি সেই কাজের প্রতি আপনার উদ্দেশ্য খুঁজে পেলেন। বড় কিছু না, গান শেখা, নতুন একটি ভাষা শেখা, ছবি আঁকার মত নান্দনিক কিছুও হতে পারে"।
মানুষকে সাহায্য করা, তাদের সুস্থ করে তোলা কিংবা সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসা বিদ্যার নানামুখী তথ্য শেয়ারের মধ্য দিয়েও তিনিও যে জীবনের অর্থ খুঁজে পান, তা জানান ড. গুপ্ত।
পরিশেষে ড. গুপ্ত বলেন, মানুষ আমার কাছে প্রায়ই জানতে চায় যে তাদের আলঝেইমার'স সনাক্তের পরীক্ষা করানো উচিৎ কিনা; তারা ভাবে শুধুমাত্র বংশানুক্রমিকভাবে তাদের এ রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ মাত্র এক-চতুর্থাংশ মানুষের এ রোগে আক্রান্তের পারিবারিক ইতিহাস থাকে; অন্যদিকে এক শতাংশেরও কম মানুষের দেহে আগে থেকে এ রোগের বীজ থাকতে পারে।
বয়স ত্রিশের কোঠা পেরোলেই অনেকে হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তারের চেম্বারে চলে আসেন আলঝেইমার'স সনাক্তের পরীক্ষা করতে। অথচ বংশানুক্রমিকভাবে আক্রান্তের চাইতে জীবনচর্চা অনেকাংশে বেশি দায়ী এসব স্নায়বিক রোগের জন্য। ফলে সময় থাকতে সচেতনতার সাথে সুঅভ্যাস গড়ে তোলার আহবান জানান তিনি।
- সূত্র: প্রিভেনশন ডট কম