ভারতে একজন আমলা প্রতি মিনিটে গড়ে ১৬ বার 'স্যার' ডাকেন
বিশেষভাবে চিহ্নিত তোয়ালে, উচ্চতা কমানো-বাড়ানো যায় এমন চেয়ার, অনুমতির বহর এবং সময়ানুবর্তিতা বাড়ানোর নিরন্তর প্রয়াস- তিন বছরের গবেষণায় ভারতের আমলাতন্ত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্ত করেছেন একজন শীর্ষস্থানীয় একাডেমিক ও ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা।
২০০৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দেন কৌশিক বসু। পরবর্তীতে তিনি বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হন।
সদ্য প্রকাশিত স্মৃতিকথা পলিসি মেকার্স জার্নাল-এ কৌশিক বসু ভারতের বিশাল আমলাতন্ত্র কীভাবে পরিচালিত হয়, সে সম্পর্কে অনেক মজাদার স্মৃতিচারণ করেছেন। সেসবের কিছু তুলে ধরা হলো এ লেখায়।
জি স্যার!
ভারতের আমলামহলে 'স্যার' শব্দটি বহুল ব্যবহৃত।
এক সরকারি বৈঠকের সময় শব্দটি কতবার বলা হবে, তার হিসেব রাখার সিদ্ধান্ত নেন অধ্যাপক বসু।
ওই সভায় একজন সিনিয়র কর্মকর্তা প্রতি মিনিটে গড়ে ১৬ বার 'স্যার' শব্দটি উচ্চারণ করেন (ওই সভায় একজন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন)।
শব্দটি উচ্চারণ করতে আধ সেকেন্ড লাগে ধরে নিয়ে অধ্যাপক বসু হিসেব কষে দেখেছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের মোট কর্মঘণ্টার ১৩ শতাংশ সময়ই খরচ হয় 'স্যার' বলতে বলতে।
অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা
অধ্যাপক বসু আবিষ্কার করেছেন, সরকারি দপ্তরগুলোতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজের জন্যও অনুমতি নিতে হয়।
কোনো অনুমতির আবেদন ধাপে ধাপে সরকারের নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চপর্যায়ে পৌঁছায়। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, অতি তুচ্ছ অনেক ব্যাপারও উচ্চপর্যায়ে, মূলত মন্ত্রীর কাছে যায় অনুমতির জন্য।
ভারতের সরকারি দপ্তরে—অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে যাওয়ার জন্য একদিন ছুটি নেওয়া থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ে পরিবেশন করা কফির ব্র্যান্ড বদলানো, এমনকি বাথরুমের পরিচ্ছন্ন কর্মী বদলানো পর্যন্ত—প্রায় সব কাজের জন্য আক্ষরিক অর্থেই অনুমতির আবেদন করতে হয়।
এই জাতীয় প্রস্তাব শক্ত কার্ডবোর্ডের ফোল্ডারে এক কর্মকর্তার ঘর থেকে অন্য কর্মকর্তার ঘরে অনুমোদনের আশায় ঘুরে বেড়ায়।
দরজায় নক নিষেধ!
অধ্যাপক বসু তার পর্যবেক্ষণে দেখেছেন, ভারতের সরকারি দপ্তরে দরজায় নক করা অভদ্রতা। 'হয় কোনো কর্মকর্তার অফিসে আপনার প্রবেশাধিকার আছে, অথবা নেই।'
যদি অধিকার থাকে, তাহলে সোজা ওই কর্মকর্তার অফিসে ঢুকে যাওয়াই নিয়ম।
অধ্যাপক বসু লিখেছেন, 'এই রীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমার কিছুটা সময় লেগেছে। কারণ পশ্চিমে কারও রুমে প্রবেশের আগে নক করার রীতি কঠোরভাবে পালন করা হয়।'
এই নতুন রীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে তিনি ছোট একটা সমস্যায় পড়েছিলেন।
'ভারতের স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ার কারণে দরজাগুলো ফুলে উঠে জ্যাম হয়ে থাকে। কাজেই দরজা খোলার জন্য বেশ জোরে ধাক্কা দিতে হয়,' লিখেছেন তিনি।
এছাড়াও কারও অফিসে ঢোকার সময় নক তো করা হয়ই না, উপরন্তু অনেকেই একেবারে আচমকা ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
দেরি করা বারণ
অর্থ মন্ত্রণালয়ে অধ্যাপক বসু দেখেছেন কাগজপত্র ও নথি রাখার প্রতিটি ফোল্ডারের ভেতর দুটি পৃষ্ঠা আছে। ওই পৃষ্ঠা দুটোতে বিভাগীয় প্রধান ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত ৪৪টি সাধারণ বাক্যাংশ পেয়েছেন তিনি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসবের মধ্যে অনেকগুলো বাক্যই সময়নিষ্ঠা মেনে চলা এবং বিলম্ব এড়ানোর উপদেশ। যেমন:
–দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ
–বিলম্ব অগ্রহণযোগ্য
–বিলম্ব এড়ানো আবশ্যক
–বিলম্ব করলে ব্যাখ্যাপ্রদান বাধ্যতামূলক
–আজই/অতিসত্বর/অবিলম্বে উত্তর দিন
–আজই ইস্যু করুন
অধ্যাপক বসু লিখেছেন, 'এমন সব অনুরোধের পরও ভারতে সময়ানুবর্তিতা মেনে চলা হয় না।'
এই মন্তব্যের পরপরই তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে ১০–১৫ বছর আগের চেয়ে ভারত এখন অনেক বেশি সময়ানুবর্তী দেশ।
সঠিক চেয়ারে বসেছেন তো?
অফিসিয়াল সভায় পদমর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক বসু আবিষ্কার করেছেন, চেয়ারের উচ্চতা পদমর্যাদায় আরেকটু জেল্লা আনতে পারে।
অপেক্ষাকৃত উঁচু চেয়ারে বসে অন্যদের দিকে চোখ নিচু করে তাকাতে পারলে সভাগুলোতে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়।
এই সুবিধা অর্জনের একটি সহজ কৌশল খুঁজে বের করেছিলেন অধ্যাপক বসু।
ভারতের সরকারি দপ্তরগুলোর বেশিরভাগ চেয়ারের ডান হাতলের নিচে একটা ছোট্ট লিভার থাকে। সবার অজান্তে আস্তে করে ওই লিভার ঘুরিয়ে চেয়ারের উচ্চতা বাড়িয়ে নেওয়া যায়। তবে মুশকিল হচ্ছে, সভায় অংশ নেওয়া সবাই-ই যদি এই কৌশল খাটায়, তবে কেউই উপকার পাবে না।
তোয়ালের শ্রেণিবিন্যাস
অধ্যাপক বসু অর্থ মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার পর তার অধীনস্থ কর্মচারীদের প্রথম ঝগড়া বাঁধে মন্ত্রণালয়ের দোতলার বড়, সুসজ্জিত বাথরুমে অধ্যাপক বসুর প্রবেশাধিকার নিয়ে। বাথরুমটি সরকারের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল।
ওই বাথরুমে তিনটি তোয়ালের তাক আছে। প্রতিটি তাকে পরিষ্কার, পরিপাটি তোয়ালে রাখা থাকে। তাক তিনটিতে যথাক্রমে লেখা থাকত—অর্থ সচিব, রাজস্ব সচিব, এবং ব্যয় সচিব। অর্থাৎ এই তিন পদমর্যাদার ব্যক্তির জন্যই কেবল বাথরুমটি নির্দিষ্ট।
অধ্যাপক বসুর কর্মচারীদের দাবি ছিল, ওই বাথরুম ব্যবহারের অধিকার তার আছে।
তিনি লিখেছেন, 'তাদের অহমে ঘা লেগেছিল।' অধ্যাপক বসু ওই বাথরুমে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে রাজি ছিলেন না।
কিন্তু তার কর্মচারীরা জোর 'লড়াই' চালিয়ে যায়। অবশেষে 'অভিজাত বাথরুমে' প্রবেশাধিকার পান অধ্যাপক বসু। সিইএ (চিফ ইকোনমিক অ্যাডভাইজার) লেখা চতুর্থ একটা তোয়ালের তাক তৈরি হয় তার জন্য।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসার সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬৩ তম।
ভারতের সরকারি কাজকর্মের বড় একটি অংশই নানা রীতিনীতি ও লাল ফিতার ঘেরাটোপে আটকা পড়ে থাকে।
অধ্যাপক বসুর মতে, আমলাতন্ত্রের এই দীর্ঘসূত্রতাকে ঔপনিবেশিক খোঁয়ারি (কলোনিয়াল হ্যাংওভার) বলা চলে। আমলারা এভাবে কাজ আটকে রেখে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে ভালোবাসেন।
- সূত্র: বিবিসি