ভালোবাসার সন্ধানে উড়ছে শেষ মুক্ত ম্যাকাও
বিধিনিষেধের বেড়াজাল উপেক্ষা করে নিষিদ্ধ প্রেমের দিকে ঝুঁকেছে জুলিয়েট। অনেকে এমনটা দাবি করলেও, খুব সম্ভবত নিঃসঙ্গতাই তাকে টেনে আনে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর চিড়িয়াখানায়।
জুলিয়েট নামটি চিড়িয়াখানা কর্মীদের দেওয়া। নীল-হলুদ ম্যাকাও পাখি জুলিয়েট এখন রিও ডি জেনিরোর জঙ্গলে উড়ে বেড়ানো সর্বশেষ মুক্ত পাখি। একসময় ব্রাজিলের এই শহরজুড়ে ছিল ম্যাকাওদের রাজত্ব। কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা একমাত্রে এসে ঠেকেছে।
গত দুই দশক ধরে প্রায় প্রতিদিন সকালে চিড়িয়াখানায় আসে জুলিয়েট। চিড়িয়াখানার যে অংশে অন্যান্য ম্যাকাও থাকে, সেখানে চলে ওর উঁকি-ঝুঁকি। কিন্তু ঘেরের কারণে তাকে বাইরেই থাকতে হয়। কখনো-বা তারের বেড়াজালের মধ্য দিয়েই প্রেমিক ম্যাকাওয়ের কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করে জুলিয়েট। সে সময় যুগলদের মতোই আচরণ করে তারা। ঘের উপেক্ষা করেই দুজন পরস্পরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা চালায়।
মাঝে-মধ্যে জুলিয়েট এসে চুপচাপ বসে থাকে। নীরবে অন্য ম্যাকাওদের উপস্থিতি উপভোগ করে সে।
জুলিয়েট কি হুটোপুটি আর চিৎকার করতে থাকা চিড়িয়াখানার অন্য ম্যাকাও বন্ধুদের চেয়ে শান্ত আর নম্র? নাকি অনেক বেশি লাজুক?
নীল-হলুদ ম্যাকাওরা সাধারণত ৩৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে। পরিবেশবাদী সংগঠন হায়াসিন ম্যাকাও ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট নেইভা গেজেসের মতে, জুলিয়েট আর ছোট নেই। বহু আগেই তার জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়ার কথা। কিন্তু সে এখনো জোড় বাঁধেনি। কোনো সন্তান নেই তার, বাসাও বানায়নি। আর তাই খুব সম্ভবত জুলিয়েট এখন পর্যন্ত 'শুধু প্রেম করে চলেছে'।
গেজেস বলেন, 'ম্যাকাও একটি সামাজিক পাখি। তার মানে, ওরা একা থাকতে পছন্দ করে না। সেটা উন্মুক্ত প্রকৃতিতে হোক কিংবা আবদ্ধ অবস্থায়। ওদের সঙ্গ প্রয়োজন।'
গেজেস শহুরে ব্যবস্থায় ম্যাকাওদের বসতি নিয়ে একটি গবেষণা প্রকল্পের সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আরও বলেন, 'জুলিয়েট সম্ভবত নিঃসঙ্গ বোধ করে। আর তাই সে ঘেরের কাছে গিয়ে যোগাযোগ ও অন্যদের সংস্পর্শে আসার চেষ্টা চালায়।'
রিও ডি জেনিরোর ফেডারেল ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী মারসেলো রেইনগ্যান্টজ জানান, জুলিয়েটের আগে রিওতে সর্বশেষ কোনো নীল-হলুদ ম্যাকাও পাখিকে মুক্তভাবে উড়তে দেখা গেছে সুদূর অতীত ১৮১৮ সালে। জনৈক অস্ট্রেলিয়ান প্রকৃতিবিদ সেটির দেখা পেয়েছিলেন। এছাড়া শহরে অন্য প্রজাতির ম্যাকাও নেই বলেও উল্লেখ করেন মারসেলো।
২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র 'রিও'তে থাকা যুগল পাখি স্পিক্স'স ম্যাকাও প্রজাতির। ব্রাজিলের অপর এক অঞ্চলে ওই প্রজাতির দেখা মেলে। তবে সম্ভবত মুক্ত অরণ্যে ওই ম্যাকাও এখন বিলুপ্ত।
উজ্জ্বল পালকে সাজানো আর কোলাহলপূর্ণ হওয়ায় গহীন জঙ্গলেও সহজেই পরস্পরের সন্ধান পায় ম্যাকাও। কিন্তু একই কারণে ওরা শিকারি এবং প্রাণী পাচারকারীদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। ব্রাজিলের অন্যান্য অঙ্গরাজ্য এবং আমাজনেও দেখা মেলে এই পাখিদের। ধারণা করা হয়, জুলিয়েটও বন্দি অবস্থা থেকে পালিয়ে এসেছে।
জুলিয়েটের আগ্রহ চিড়িয়াখানার কোনো নির্দিষ্ট রোমিও ম্যাকাওর প্রতিই কি না, এ বিষয়ে নিশ্চিত নন বায়োপার্কের জীববিজ্ঞানীরা। এমনকি জুলিয়েট আসলেই স্ত্রী প্রজাতির ম্যাকাও কি না, সে বিষয়েও তারা নিশ্চিত নন। কেবলমাত্র চোখে দেখে ম্যাকাওর লিঙ্গ নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব। প্রজনন অঙ্গ পর্যবেক্ষণ কিংবা পালক বা রক্তের জিনগত পরীক্ষার মাধ্যমে ম্যাকাওয়ের লিঙ্গ নির্ধারণ করতে হয়।
চিড়িয়াখানার ভেতর দাঁড়িয়ে জীববিজ্ঞানী অ্যাঞ্জেলিটা কাপোবিয়াঙ্কো বলেন, যাই করা হোক না কেন, মানুষের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে গিয়ে ওদের ওপর স্রেফ হস্তক্ষেপ করা হবে। জুলিয়েট দেখতে পরিপুষ্ট। এছাড়া সে উড়ে বেড়ায় বেশ উঁচুতে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাই ওকে ঘেরের ভেতর নিয়ে আসার কথা ভাবছে না।
'আমরা মানবীয় অনুভূতি বিবেচনায় কিছু করতে পারি না। আমি ওকে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ানো একটি প্রাণ হিসেবে দেখতে পাই,' বলেন কাপোবিয়াঙ্কো। জুলিয়েট কখনোই বিরক্ত করার মতো কিছু করেনি। এমনকি জোর করে সে বেড়াজালেও ঠোকরায় না।
'সে শুধু এখানেই থাকবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমি কে? আমি এমন সিদ্ধান্ত নেব না। সে আসে এবং চলে যায়। ওর পালকগুলোও ভীষণ সুন্দর,' বলেন তিনি।
প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আরোপিত কোয়ারেন্টিন এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে মানুষ এখন স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর আবেদন কী তা জানে। গেজেস বলেন, ম্যাকাওরা সাধারণত দিনে ৩০ কিলোমিটারের বেশি পরিসরে উড়ে বেড়াতে অভ্যস্ত।
গত বছর 'বায়োপার্ক' চিড়িয়াখানা ম্যাকাওদের জন্য জায়গা বৃদ্ধি করে। এক হাজার স্কয়ার মিটার সম্পন্ন এই ঘেরে ম্যাকাওরা সবুজ টিয়া আর সোনালি তোতাদের সঙ্গে উড়ে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে রঙিন এক বলয়ের সৃষ্টি করে। আগের মাত্র ১০০ স্কোয়ার ফিটের ঘের থেকে এখনকার এই ঘের অনেক বিশাল। রিওর জরাজীর্ণ চিড়িয়াখানার বেসরকারিকরণ এবং ১৭ মাসের সংস্কারের পর মার্চে পাখিদের এই অভয়ারণ্য পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
বায়োপার্ক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের তুলে ধরতে ইচ্ছুক। এ রকম একটি উদ্যোগ হলো রিফওনা। বাস্তুতন্ত্র পুনঃর্নিমাণের প্রতি নজর রেখে সুরক্ষিত অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা এই প্রকল্পের লক্ষ্য। বায়োপার্কের সঙ্গে মিলিতভাবে তারা নীল-হলুদ ম্যাকাওদের প্রজননও শুরু করতে যাচ্ছে।
প্রকল্প অনুসারে বাবা-মায়ের অধীনে ২০টি বাচ্চাকে জঙ্গলে খাদ্য অনুসন্ধান, শিকারিদের কাছ থেকে আত্মরক্ষা এবং বৈদ্যুতিক লাইন এড়িয়ে চলার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপর ওই অল্পবয়সী পাখিগুলোকে রিওর বিশাল টিজুকা ফরেস্ট ন্যাশনাল পার্কে ছেড়ে দেওয়া হবে। জুলিয়েটকেও ওই পার্কে দেখা গেছে। ধারণা করা হয়, প্রতি রাতে সে ওখানেই ঘুমায়।
রিফওনার প্রযুক্তিগত সমন্বয়কারী জীববিজ্ঞানী রেইনগ্যান্টজ বলেন, 'বাস্তুসংস্থান ও বনায়নের ক্ষেত্রে ওদের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশাল চঞ্চুবিশিষ্ট এই বড়সর পাখি সবচেয়ে বড় বীজও ফাটাতে সক্ষম। সব পাখি তা পারে না। পরিকল্পনা হলো, ম্যাকাওদের জন্য এই বীজগুলো ছড়িয়ে দেওয়া। জঙ্গলের বাকি প্রাণী যারা এগুলো ফাটাতে পারে না, ওদের চেয়ে এই বীজ ম্যাকাওদের বাড়তি সুবিধা দিবে।'
মহামারির কারণে বিলম্ব ঘটায় প্রকল্পটি এখন ধীরগতিতে পুনরায় শুরু হয়েছে। রেইনগ্যান্টজের বিশ্বাস, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ টিজুকায় নীল-হলুদ ম্যাকাওদের ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দুই দশকের নিঃসঙ্গতার পর জুলিয়েট বন্ধুদের সঙ্গে ওড়ার সুযোগ পাবে। নেভিস বলেন, জুলিয়েট ওদের জঙ্গলে বিচরণের বিষয়টি শেখাতে পারবে। এমনকি, নিজের জন্য ভালোবাসাও খুঁজে নিতে পারবে।
-
এপি থেকে অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা