মহামারির কঠিন সময়ে আড়ালের নায়ক অ্যাম্বুলেন্স চালকরা
মোহাম্মদ পলাশ। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। ঢাকা শহরে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে নিজের জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। সপ্তাহ তিনেক আগে একজন রোগীকে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তার মোবাইলে কল আসে। তার সহকারী হৃদয়কে নিয়ে তিনি দ্রুততম সময়েই রোগীর বাসার সামনে যান। ওই রোগী ছিলেন একজন বয়স্ক নারী যার শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। অ্যাম্বুলেন্সেই ওই নারীকে তারা সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন দেন। এরপর ওই নারীকে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা রোগীকে হাসপাতালের 'নতুন ভবনে' পাঠান। ওই ভবনটি আগে থেকে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
সমস্ত কাজের শেষে পলাশ আর হৃদয় বুঝতে পারলেন, দীর্ঘ সময় ধরে যে রোগীর সংস্পর্শে তারা দুজনে ছিলেন তিনি মূলত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
"আমরা অনেক রোগীকে নিয়েই অ্যাম্বুলেন্সে আসা যাওয়া করি এবং তাদের কেউই রোগের কথা আমাদের জানান না। বিশেষ করে কেউ যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে তা আরও বেশি করে লুকান। তাই আমরা কখন করোনা আক্রান্ত রোগী নিয়ে চলাফেরা করি আর কখন করি না, আমরা নিজেরাও জানি না," বলছিলেন অ্যাম্বুলেন্স চালক পলাশ।
কিন্তু এ নিয়ে তেমন কিছু করারও নেই তাদের। কারণ অ্যাম্বুলেন্স চালানোই তাদের উপার্জনের একমাত্র উপায়। ফ্রিল্যান্স আম্বুলেন্স চালক হিসেবে ও ট্রিপ প্রতি মালিকের কাছ থেকে টাকা পান তারা।
তারা জানান, হাসপাতাল বা বাসায় রোগীদের প্রত্যেকবার নামিয়ে দিয়ে আসার পর তারা অ্যাম্বুলেন্স জীবাণুমুক্ত করেন। কিন্তু রোগীরা যদি নিজেদের রোগের কথা লুকিয়ে রাখেন, তবে সেটা তাদের নিজেদের যেমন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে, তেমনি ঝুঁকিতে ফেলে ওই অ্যাম্বুলেন্সে পরবর্তীতে চলাচল করা অন্য রোগীদেরও।
তারা বলছেন, দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক বা পিপিই পরার অভ্যাস তৈরি করেছেন তারা। পিপিই যদিও একবার ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়, তবে সেটি বারবার কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই একই পিপিই ফেলে না দিয়ে পরিষ্কার করে বারবার পরেন তারা।
ভাই ভাই অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ভাড়া প্রতি চুক্তিতে অ্যাম্বুলেন্স চালান পলাশ। অধিকাংশ সময়ই পলাশ বা অন্য চালকরা যখন রোগীদের নিয়ে হাসপাতালে যান তখন রোগীদের রোগ সম্পর্কে তাদের জানার কোনো সুযোগ থাকে না।
পলাশ আর হৃদয়ের মতো এরকম বহু অ্যাম্বুলেন্স চালক আছেন, যার দেশের এই সংকটের সময় করোনায় আক্রান্ত রোগীদের বা করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে যাওয়া লোকদের হাসপাতালে আনা নেওয়ার কাজটি নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে সব মিলিয়ে প্রায় ৯ হাজার ৫০০ অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এরমধ্যে ৪ হাজার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকা শহরের ভেররের রোগীদের হাসপাতালে আনা নেওয়ার কাজ করে। সবমিলিয়ে এই খাতে কাজ করেন প্রায় ১৪ হাজার মানুষ।
সংগঠনটির সভাপতির ভাষ্যমতে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুর দিকে কোনো কোনো অ্যাম্বুলেন্স চালক রোগী আনা নেওয়ার কাজে অনীহা দেখালেও বর্তমানে প্রায় সবাই কাজ করছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের কীভাবে আনা নেওয়া করতে হবে, সময় এবং স্থানের অভাবে এই চালকদের সে প্রশিক্ষণও দেওয়া যায়নি। তবুও নিজেদের স্বল্প জ্ঞান নিয়ে দেশের মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সামনে থেকে লড়াই করে যাওয়া চিকিৎসক, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবাকর্মী, পুলিশদের যেখানে সবাই অভিবাদন জানাচ্ছে, সেখানে সবাই ভুলে যান মহামারির সময়ে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া এই অ্যাম্বুলেন্স চালকদের।
অভিবাদন হয়তো অনেক পরের বিষয় কিন্তু তাদের কাছে পর্যাপ্ত পিপিই আছে কিনা সে খোঁজ নিজে কর্তৃপক্ষ? এই কাজে তাদের কী পরিমাণ ঝুঁকি রয়েছে সে বিষয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালকদের কোনো ধারণা আছে? তারা যদি আক্রান্ত হন সেক্ষেত্রেই বা কী হবে?
করোনায় আক্রান্তদের পরিবহনে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্স চালক
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের পরিবহনে নিয়োজিত কয়েকজন অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে কথা হয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এই প্রতিবেদকের। এদের মধ্যে একজন হলেন ২৭ বছর বয়সী যুবক কাজল। কাজল এবং তার বন্ধু প্রদীপ দুজনেই অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আনা নেওয়ার কাজ করেন।
তাদেরকে নিয়মিতই হাসপাতাল থেকে পিপিই সরবরাহ করা হয়। একবার ব্যবহারের পর সেগুলো পুড়িয়েও ফেলা হয়। তবে এরমধ্যেও দুজনেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যান। এই দুই বন্ধু বুঝতেও পারেননি এতো সচেতনতার মধ্যেও কীভাবে আক্রান্ত হলেন তারা।
প্রদীপ সুস্থ্ হয়ে উঠলেও কাজল এখনও হাসপাতাল চত্বরে চালকদের জন্য বানানো আইসোলেশন রুমে আছেন। অধিকাংশ সময় একাই কাটে তার। কথা বলার জন্য এই প্রতিবেদক তার মোবাইলে ফোন দিলে বেশ খুশি হয়ে যান তিনি।
"হাসপাতালে করোনাভাইরাস ইউনিট চালু হওয়ার পর থেকে আমাদের ঝুঁকি কিছুটা কমেছে। এখন তো রোগীরা হাসপাতালে এসে সরাসরি করোনা ইউনিটে ভর্তি হয়ে যেতে পারেন। শুরুর দিকে এই রোগীদের নিয়ে আমাদের কুর্মিটোলা হাসপাতালে যাওয়া লাগতো," আইসোলেশন ইউনিটে বসেই এই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এই প্রতিবেদককে বলছিলেন কাজল।
তিনি জানান, শৈশব থেকে বিভিন্ন গাড়িতে হেল্পারের কাজ করতে হতো তাকে। ১৮ বছর বয়সেই গাড়ি চালানোটা শিখে ফেলেন তিনি। ছয় সদস্যের একটা পরিবার তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। বহুদিন ধরেই চেষ্টা করেছেন স্থায়ীভাবে কোনো কাজ করতে। অবশেষে গত সেপ্টেম্বরে ঢাকা মেডিকেলে এই চাকরিটা পেয়ে যান। পরিবার নিয়ে বেশ ভালোভাবেই চলছিলো তার। কিন্তু এর মধ্যেই চলে আসে মহামারি করোনাভাইরাস; আর তাকে দেওয়া হয় করোনায় আক্রান্ত রোগীদের আনা নেওয়ার দায়িত্ব।
তিনি জানতেনও না কীভাবে এই কাজের ভার তার ওপর এসে পড়েছে। কাজের দায়িত্ব পেয়ে প্রতিবাদও করেননি তিনি।
"দুঃসময়ে যদি মানুষের জন্য কাজ না-ই করি তবে কেমন মানুষ আমি?" নিজেই বলছিলেন সাহসী অ্যাম্বুলেন্স চালক কাজল।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরপরি নিজের পরিবারের লোকজনে গ্রামে পাঠিয়ে দেন তিনি। এখন ঢাকা মেডিকেলের আইসোলেশন ইউনিটে নিঃসঙ্গভাবে সময় কাটছে তার।
"আমার স্বীকার করতেই হবে আমার বন্ধুরা এবং সহকর্মীরা যে যতোটুকু পারে, আমার খোঁজখবর নেন। তারা দিনে তিনবেলা আমাকে খাবার দিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে তারা আমার জন্য ফলমূল নিয়ে আসে, জানালার পাশে দাঁড়ায় এবং আমার সঙ্গে গল্প করে।"
সুস্থ্য হলে আবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আনা নেওয়ার কাজে ফিরে যেতে চান বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. বাদল মাতব্বর বলেন, শুরুর দিকের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অ্যাম্বুলেন্সে করে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের আনা নেওয়া করা যেতো না।
"তবে বর্তমানে আমরা তাদের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করছি। এই অ্যাম্বুলেন্সগুলো না থাকলে আমরা বেশ বিপদে পড়তাম," বলছিলেন মো. বাদল।
তিনি বলেন, "চালকদের সুরক্ষায় বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পিপিই সরবরাহ করেছে। তবে সরকার তাদের নিরাপত্তার জন্য কিছুই করেনি।"
তিনি জানান, এ পর্যন্ত ২০০ থেকে ২৫০ জন অ্যাম্বুলেন্স চালক বা চালকের সহকারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
"আমরা ভাগ্যবান যে এখনো কোনো চালক মারা যাননি। কেউ একজন মারা গেলে চালকদের দিয়ে গাড়ি চালানো বেশ দুষ্কর হয়ে যাবে। কারণ তাদের নিরাপত্তায় যেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তেমনি তাদের জন্য কোনো প্রণোদনার ঘোষণাও দেয়নি সরকার," আক্ষেপের সুরেই বলেন অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির এ নেতা।