রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানে অ্যাম্বুলেন্স চালকেরা যেসব দুর্বিষহ ভয়াবহতার মুখোমুখি হয়েছিলেন
জুলাইয়ের শেষদিকে গুলিতে আহত এক আন্দোলনকারীর জরুরি ভিত্তিতে গাড়ির দরকার হয়। ঠিক তখনই এগিয়ে আসেন অ্যাম্বুলেন্স চালক মাসুম হোসেন।
মাসুম আহত ওই রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গাড়িতে তোলেন। পরে তাকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) নিয়ে যান।
সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাসুম বলেন, "আমরা আসাদ গেটে পৌঁছালে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা আমার গাড়ি আটকে দেয়।"
কর্মীরা মাসুমকে জিজ্ঞাসা করে যে গাড়িতে থাকা রোগী কীভাবে আহত হয়েছেন। গুলিতে আহত হয়েছে জানানোর পর তারা অ্যাম্বুলেন্স চালকের ওপর চড়াও হয়। কারণ তাদের বুঝতে আর বাকি ছিল না যে মাসুম আহত এক আন্দোলনকারীকে নিয়ে যাচ্ছেন।
মাসুম বলেন, "অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর রোগীটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল। আর এদিকে তারা আমাকে জেরা করছিল যে আমি কেন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আমি তাদের বলি, মানুষটি তো মারা যাচ্ছে। আমার কি তার জীবন বাঁচানো উচিত না? তবুও তারা আমাকে আহত ব্যক্তিটিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দিচ্ছিলেন না।"
ঘটনার একপর্যায়ে সেখানে পুলিশ আসে। তখন মাসুম তাদের গাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর পুলিশ রোগীটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়।
মাসুম বলেন, "আন্দোলনে নিহত একজনের লাশ কিশোরগঞ্জে নিয়ে গিয়েছিলাম। আন্দোলনকারীরা পথে আটকেছিল। পরে অবশ্য তারা আমাদের ছেড়ে দেয়।''
মাসুম আরও বলেন, "ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় আমার কোনো নিরাপত্তা ছিল না। রাস্তায় পুলিশ কিংবা মানুষ; কেউই ছিল না। কেবল অ্যাম্বুলেন্স ছিল। অন্য কোনো গাড়িও চোখে পড়েনি। পথে পথে আগুন জ্বলছিল এবং আমরা এর মধ্য দিয়ে যাতায়াত করছিলাম।"
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতনের দিনগুলো নিয়ে মাসুম নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করছেন। ওই সময় পুলিশ, র্যাব, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে প্রায় হাজারখানেক মানুষের মৃত্যুর বিষয়টিও তিনি স্মৃতিচারণ করেন।
ওই সময়টায় ঢাকা শহরে অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আহত ও নিহতদের রিকশা, ভ্যান ও সিএনজির মাধ্যমে আনা নেওয়া করতে হয়েছিল। তবে এই পরিস্থিতিতে অ্যাম্বুলেন্স চালকেরা ঢামেকের আশেপাশে কিংবা যাত্রাবাড়ী ও রায়েরবাগের মতো রণক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাসুম বলেন, "গত ৫ আগস্ট এই এলাকার (ঢামেক ও এর আশেপাশের) অবস্থা বেশ ভয়াবহ ছিল। শিক্ষার্থীরা চানখারপুলের দিক থেকে আসছিল। যখন তারা এদিকে পৌঁছায়, তখন পুলিশ শহীদ মিনার থেকে তাদের গুলি করতে থাকে। ওই মুহূর্তে শিক্ষার্থীরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে হাসপাতালে প্রবেশ করে। তারা (পুলিশ) আমাদের সামনে মানুষদের গুলি করেছে।"
আরেক অ্যাম্বুলেন্স চালক মোহাম্মদ শফিক বলেন, "তারা (পুলিশ) কোনো বাছ-বিচার করেনি। বাড়ির ছাদে থাকা শিশুকে পর্যন্ত গুলি করা হয়েছে। তখন পুলিশ যে কাকে গুলি করতে পারে, সেটার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না।"
আন্দোলনের সময় হাজী সিরাজুল ইসলাম খোকন নামের এক বয়স্ক অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে এক রোগীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ওইদিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, "একটা গুলি আমার বুকের উপর দিয়ে চলে যায়। আমার গাড়ির দরজা খোলা ছিল। চোখের পলকে ঘটনাটি ঘটে যায়। আমার জীবনে কখনোই এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইনি। আমি ভয়ে ও শঙ্কায় কাঁপছিলাম।"
গত ৪ আগস্ট মোহাম্মদ আকাশ রায়েরবাগ এলাকায় ছিলেন। তিনি গুলিতে আহত তিনজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় কারো চোখে কিংবা কারো বুকে গুলি লাগছিল।
আকাশ বলেন, "আমার গাড়ি রক্তে ভেসে গিয়েছিল। আমার স্ট্রেচারও রক্তে ভরে গিয়েছিল। আমি সেগুলো থেকে রক্ত মুছে ফের ঘটনাস্থলে যাই। আমি সেখানে গুলিতে আহত বহু মানুষকে দেখেছিলাম।"
মোহাম্মদ শফিক জানান, তারা অর্থ কিংবা জীবনের মায়া করেননি। আকাশ জানান, তিনি তিনি কারো থেকে টাকা-পয়সা নেননি। কেননা, 'সকলেই দেশকে মুক্ত করতে সেখানে ছিলেন।'
ইলিয়াস নামের আরেক অ্যাম্বুলেন্স চালক মাথায় গুলিবিদ্ধ এক নারীর মরদেহ নিয়ে ধামরাই গিয়েছিলেন। একইসাথে গত ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ এক শিক্ষার্থীর লাশও তিনি বরিশালে নিয়ে যান। এমন পরিস্থিতি তিনি জীবনে কখনো দেখেননি বলে জানান।
ইলিয়াস বলেন, "মানুষকে তারা যেভাবে গুলি করে হত্যা করছিল তা দেখে আমি বেশ বিপর্যস্ত বোধ করছিলাম। এমনকি তারা আমাদের ঢাকা মেডিকেলের ভেতরেও মানুষকে গুলি করেছে। আমি একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক বিধায় মরদেহ যাতায়াত করে অভ্যস্ত। তবে এবার বেশ অন্যরকম লেগেছে। কিন্তু আমরা কী করতে পারি? এটা আমার তো আমাদের পেশা।"
আন্দোলনের সময় পরিস্থিতি বেশ ভয়ানক ছিল বলে জানান আকাশ। তিনি এটিকে একটি 'সম্পূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র' বলে অভিহিত করেন।
আকাশ বলেন, "অ্যাম্বুলেন্সেও গুলি করা হয়েছিল। কিন্তু আমি ভীত হইনি। আমি ১৯৭১ সালে জন্মেছি। আমি বহু ধরনের সহিংসতা দেখেছি। তবে এমনটা আর দেখিনি। আমি চোখে গুলি লাগা ব্যক্তিদের গাড়িতে নিয়ে যাতায়াত করেছিলাম। আমার পুরো হাত-পা ও সারা শরীর রক্তে ভিজে গিয়েছিল।"