তাপমাত্রা বাড়ছে, তার সঙ্গে বাড়ছে লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানের ব্যবহার
সেপ্টেম্বরের এক অলস বিকেল। রাস্তাঘাট স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ফাঁকা। অসহ্য গরম পড়েছে।
নিজের ফ্রিজিং ভ্যানে চালকের আসনে বসে মোবাইল ফোনে ইউটিউব ভিডিও দেখছিলেন মোহাম্মদ মোস্তফা। গাড়িটি রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে দাঁড়ানো।
একজন গ্রাহকের ফোনের অপেক্ষায় বসে আছেন মোস্তফা। ওই গ্রাহকের আত্মীয় বা পরিবারের কোনো সদস্য মারা গেছে। তার মরদেহ বহন করার জন্য মোস্তফার ফ্রিজিং ভ্যান প্রয়োজন তাদের।
২৮ বছর বয়সি মোস্তফা বললেন, 'কারও কাছ থেকে ফোন কল এলেই কেবল আমি একটা ট্রিপ দিতে পারব। কিন্তু তাই বলে কারও মৃত্যু কামনা করি না আমি।'
গত চার বছর ধরে ফ্রিজিং ভ্যান চালাচ্ছেন তিনি। এর আগে আরও বছর চারেক অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছেন।
এখন মোস্তফা জনি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের হয়ে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানটির মোট ছয়টি গাড়ি আছে: দুটি ফ্রিজিং ভ্যান, একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স ও তিনটি রেগুলার অ্যাম্বুলেন্স।
ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি ফ্রিজিং ভ্যান পার্ক করা থাকে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনের জায়গাটিতে।
দিনের যেকোনো সময় এখানে অন্তত পাঁচটি ফ্রিজিং ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন। এর কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ অ্যাম্বুলেন্স মালিকই মগবাজার ও তৎসংলগ্ন এলাকায় থাকেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিরপুর-২-এ জাতীয় হৃদরোগ ফাউন্ডেশন, মুগদা হাসপাতালসহ শহরের আরও অনেক হাসপাতাল এলাকাতেও এসব ফ্রিজিং ভ্যান পাবেন।
আগে ঢাকাসহ সারা দেশেই মরদেহ বহন করা হতো অ্যাম্বুলেন্সে বা মাইক্রোবাসে করে।
কিন্তু গত এক দশকে এই চিত্র বদলে গেছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রায় ২০০টি ফ্রিজিং ভ্যান চলাচল করে। অ্যাম্বুলেন্স সেবাদাতারা জানান, মরদেহ বহনের জন্য ফ্রিজিং ভ্যানের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রথম ফ্রিজিং ভ্যান নিয়ে আসে আলিফ অ্যাম্বুলেন্স।
১৯৮৯ সালে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়া শুরু করেন আলিফ অ্যাম্বুলেন্সের মালিক মমিন আলী। তিনি বলেন, 'মানুষ যাতে তাদের মৃত আত্মীয়ের সঙ্গে আরেকটু বেশি সময় কাটাতে পারে [মরদেহে পচন ধরার ভয়ে শঙ্কিত না হয়েই], সেজন্য আমি ফ্রিজিং ভ্যান কিনেছিলাম।'
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও ফ্রিজিং ভ্যান আনতে শুরু করে। অ্যাম্বুলেন্স সেবাদাতারাও এখন ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে তাদের বহরে লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যান যুক্ত করেছে।
ফ্রিজিং ভ্যান চালক মোস্তফা বলেন, 'এখন খুব কম লোকই অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ বাড়িতে নিয়ে যায়; তারা ফ্রিজিং ভ্যানে নিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।'
দূরবর্তী জেলায় মরদেহ নিয়ে গেলে পচনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাছাড়া অনেকসময় আত্মীয়-স্বজনরা দাফনের আগে দু-একদিন লাশ রাখতে চায়, যাতে দূরের বা দেশের বাইরে থাকা আত্মীয়রা এসে মৃত ব্যক্তিকে শেষবারের মতো দেখতে পারে।
সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এসব ভ্যান ভাড়া করে। তবে ধনী পরিবারই ফ্রিজিং ভ্যান নেয় বেশি।
পাবলিক ইমার্জেন্সি হেল্পলাইন ৯৯৯-এ ডায়াল করে ফ্রিজিং ভ্যান বা অ্যাম্বুলেন্স নেওয়া যায়। অনলাইনভিত্তিক অ্যাম্বুলেন্স সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানও আছে বেশ কিছু।
লাশ বহনকারী ফ্রিজিং ভ্যানের ভাড়া অ্যাম্বুলেন্সের চেয়ে বেশি। অ্যাম্বুলেন্স সেবাদানকারী কোম্পানি টুয়েন্টিফোর অ্যাম্বুলেন্সের ওয়েবসাইটে একটি মূল্য তালিকা রয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ঢাকা থেকে সাভারে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করলে ৩ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। কিন্তু লাশ বহনকারী ফ্রিজার ভ্যান নিলে ভাড়া পড়বে ৪ চার হাজার টাকা।
দীর্ঘ দূরত্বের জন্য ভাড়া বেশি আসে। ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া যেতে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ১৬ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়। ফ্রিজিং ভ্যানের ক্ষেত্রে ভাড়া গুনতে হয় ২২ হাজার টাকা।
তবে বাড়তি খরচ আছে। আগেই বলা হয়েছে, অনেকে এক বা দুই দিন লাশ রাখার জন্য ফ্রিজিং ভ্যান ভাড়া করে। সেক্ষেত্রে কোম্পানি প্রতি ঘণ্টায় ওয়েটিং চার্জ হিসেবে অন্তত ৫০০ টাকা নেয়।
রেন্ট-এ-কার ব্যবসার মতোই অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদানকারীরাও ছোট ব্যবসায়ী। তাদের বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব থাকে।
মোহাম্মদ শাহাদাত ২০১৭ সালে একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি দুই বন্ধুর সঙ্গে মিলে টুয়েন্টিফোর কোম্পানি গঠন করেন।
তিনি জানান, এখন তাদের সাতটি ফ্রিজিং ভ্যান আছে। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনে, মহাখালী ও মিরপুর-১০-এর নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় এসব ভ্যান রাখেন তারা।
শাহাদাত বলেন, শহরের ভেতরে সার্ভিস চার্জ আড়াই হাজার টাকা এবং ওয়েটিং চার্জ প্রতি ঘণ্টায় ৫০০ টাকা।
ক্রমবর্ধমান চাহিদা দেখে বহরে তারা আরও ফ্রিজিং ভ্যান যোগ করেছেন।
শাহাদাত বলেন, 'এই গাড়িগুলো জাপান থেকে আমদানি করা হয়। আর একটা সিঙ্গেল ফ্রিজিং ভ্যানের দাম প্রায় ৩০ লাখ টাকা।'
দেশে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার পরিমাণ নির্ধারণের কোনো নির্দেশিকা নেই বলে তারা ভাড়া বাড়াতে পারেননি বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, 'কয়েক বছর আগে ব্যবসা ভালো ছিল। কিন্তু এখন জ্বালানির দাম বেড়েছে, অথচ আমরা ভাড়া বাড়াতে পারিনি। ফলে লাভের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।'
তবে হাওলাদার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের ওপরই ব্যবসা নির্ভর করে। তার কোম্পানির তিনটি অ্যাম্বুলেন্স ও একটি ফ্রিজার ভ্যান রয়েছে।
'হাসপাতালের সাথে যাদের ভালো সম্পর্ক আছে, তারা ভালো ব্যবসা করে,' সাইফুল বলেন। তারা মূলত অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে কাজ করেন।
তিনি জানান, অ্যাম্বুলেন্সের তুলনায় ফ্রিজিং ভ্যান থেকে লাভ খানিকটা বেশি আসে। কারণ ফ্রিজিং ভ্যান চালানোর খরচ একটু কম।
বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, 'ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে এ ধরনের লাশবাহী ভ্যানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। [চাহিদা বাড়ার] একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা। উচ্চ তাপমাত্রায় মরদেহ ভালো অবস্থায় রাখা কঠিন।'
তিনি আরও বলেন, চাহিদা বাড়ার কারণে কোম্পানিগুলো ফ্রিজিং ভ্যান আমদানি বাড়িয়েছে।