মানুষের সেবায় 'বৃহন্নলা'
অ্যাম্বুলেন্সে করে শাহ আলম বেপারী নামের এক রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের করোনা ইউনিটের সামনে নিয়ে আসলে ৪/৫ জন মানুষ ছুটে এলেন রোগীর কাছে। একজনের হাতে ছিল 'আমি স্বেচ্ছাসেবক। কিভাবে সাহায্য করতে পারি?' লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড। রোগীর সাথে থাকা তার মেয়ে শাহনাজের সাথে কথা বলে রোগীকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন তারা।
কমলা রঙের জ্যাকেট পরা মানুষগুলো রোগীকে ধরাধরি করে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে করে আইসিইউতে পৌঁছে দিয়ে আসলেন। শুধু তাই নয় সাথে থাকা রোগীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও পৌঁছে দিলেন রোগীর জন্য নির্ধারিত শয্যার কাছে।
মহামারীর এ সময়ে যেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীকে কাছের মানুষেরাও পরিত্যাগ করছে, তখন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এ মানুষগুলো। আক্রান্ত হবার ভয়ে অনেকে যেখানে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া মানুষগুলোর পাশে এসে পর্যন্ত দাঁড়ায় না, সেখানেই ১৫ জনের এই দলটি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত করোনা ইউনিটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে করোনা আক্রান্তসহ যে কোন রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে এবং হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে মমতার হাত।
এদের সবার আরেকটি পরিচয়, এরা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'বৃহন্নলা'র এ কর্মীরা গত ১৫ এপ্রিল থেকে এভাবে সেবা দিয়ে আসছেন।
রোগী শাহ আলম বেপারীর মেয়ে শাহনাজ টিবিএসকে বলেন, 'তারা যেভাবে এ সংকটময় মুহুর্তে আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। যেখানে হাসপাতালে রোগী দেখলে মানুষ কাছে আসতে চায় না সেখানে তাদের এ কার্যক্রম আসলেই মহানুভবতার পরিচয় দেয়'।
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ৫ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ১০ জন স্বেচ্ছাসেবক এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ রোগী ও রোগীর পরিবার সাদরে গ্রহণ করলেও কেউ কেউ অবশ্য তাদেরকে এড়িয়ে যান। তবে এ বিষয়টি নিয়ে তারা মোটেও হতাশ কিংবা ক্ষুব্ধ নন।
'বৃহন্নলা'র সদস্য চাঁদনী আক্তার টিবিএসকে বলেন, 'যখন আমরা কালেকশনে যাই তখন নিজের কাছেই খারাপ লাগে কিন্তু এ মহৎ কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পেরে ভাগ্যবান মনে করছি। কোভিড রোগীদের সহযোগিতা করতে গিয়ে কখনও নিজের মধ্যে ভীতি কাজ করে না। আমরা আমাদের সুরক্ষার জন্য মাস্ক, হেড শেড, হ্যান্ডগ্লাভস পড়ে থাকি। এছাড়া কিছুক্ষন পর পর হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে স্যানিটাইজড করে নেই'।
তাদের এ কাজের সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন সুরক্ষা উপাদান উপহার দিতে আসা রোজানা আক্তার বলেন, 'তাদের এ মহৎ কাজে নিজেকে একটু সম্পৃক্ত করার জন্য তাদেরকে ফেস শেড, স্যানিটাইজার, মাস্ক দিয়েছি। আমি এটা প্রচার করতে চাই না, তারা এত মহৎ একটা কাজ করছে এজন্য একটু সহযোগিতা করলাম, এটাই আমার প্রাপ্তি'।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী, সংগঠনটির সভাপতি ও তাদের এ কার্যক্রমের দলনেতা সাদিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমরা গত বছর করোনার শুরু থেকেই কাজ করে আসছি। বিভিন্ন স্থানে মাস্ক বিতরণ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার ও কিছুক্ষণ পর পর হাত ধোয়ার প্রচার করেছি। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় মাঝে আমাদের কার্যকম কয়েক মাস বন্ধ ছিল। তবে ইদানিং করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় গত ১৫ এপ্রিল থেকে আমরা এখানে এ কার্যক্রম করে আসছি'।
তাদের এ কাজকে সবাই সাধুবাদ জানালেও হাসপাতালের কর্মচারী এবং স্টাফরা (দালাল) বিষয়টি ভালোভাবে নিচ্ছেন না উল্লেখ করে সাদিকুল বলেন, 'ভালো কাজ করতে গেলে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা যেহেতু এতো বড় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি সেক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোকে তেমন বাঁধা মনে করি না'।
তাদের সাথে স্বাচ্ছন্দে ১০ জন ট্রান্সজেন্ডার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন উল্লেখ করে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আসিফ আহমেদ বলেন, 'যখন আমরা কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের সহযোগিতা করি তখন আমাদের মধ্যে এর কোনো ভীতিই কাজ করে না। এখানে কোনো অ্যাম্বুলেন্স এলে সবাই করোনা রোগী ভেবে নিজেদের সুরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেন। বৃহন্নলার সদস্যরা ঝুঁকি মনে না করেই মানবতার সেবা করছেন'।
স্বেচ্ছাসেবক মুনমুন আক্তার টিবিএসকে বলেন, 'মানুষের পাশে দাঁড়াতেই আমরা কাজটি বেছে নিয়েছি যাতে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হয়। আমরা অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুটা হলেও রোগীদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে পারছি'।
শুধু কোভিড রোগীদের হাসপাতালে সহযোগিতাই নয়, 'বৃহন্নলা'র সদস্যরা অসহায় মানুষের সেবায় একটি তিন চাকার অটো গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন। এতে প্রতিদিন অন্তত ১৫ জন রোগীকে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বলে জানান তারা। তাদেরকে অবগত করলেই এ গাড়ি দিয়ে রোগী ও তার স্বজনের যাতায়াতও নিশ্চিত করছে সংগঠনটি।
ঢাকার অদূরবর্তী শনির আখড়া, আজিমপুর, খিলগাঁও, চিটাগং রোড, পোস্তগোলা, ঝিগাতলা, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে তারা রোগী ও রোগীর স্বজনদের পৌঁছে দিয়েছেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।