শিক্ষাগ্রহণ করে বাধা ভাঙতে চায় বাংলাদেশের তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়
বাংলাদেশে প্রথাগত লিঙ্গের ভূমিকা গভীরভাবে প্রোথিত। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের মানুষ শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনে অস্বাভাবিক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের পরিচালিত একটি গবেষণায় তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের লড়াইয়ে যেসব গুরুতর বাধার মুখোমুখি হন সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাদিকুল ইসলাম, বৃহন্নলা, মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও মো. আরিফুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের অব্যক্ত অভিজ্ঞতার ওপর দৃষ্টি দেওয়া করা হয়েছে। এতে অধ্যবসায়, আকাঙ্ক্ষা ও পদ্ধতিগত ব্যর্থতার গল্পগুলো উঠে এসেছে।
বাধা
'টিচার্স ওয়ার্ল্ড: জার্নাল অব এডুকেশনে' প্রকাশিত এই গবেষণাটি আটজন প্রাপ্তবয়স্ক তৃতীয় লিঙ্গের অংশগ্রহণকারীর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তৃতীয় লিঙ্গ একটি লিঙ্গ পরিচয়, যা শতাব্দী ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যমান।
গবেষণায় উঠে এসেছে শিক্ষার প্রতি অদম্য তৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হন।
সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে তাদের যৌন পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হওয়া। এছাড়াও সহপাঠীদের কাছ থেকে হয়রানি ও শিক্ষকদের কাছ থেকে অজ্ঞতা বা উদাসীনতা।
এই বাধাগুলো তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে বাধা দেয়। যার ফলে তারা শিক্ষাগ্রহণের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। গবেষকরা সমস্যার মাত্রা নির্ধারণের জন্য গভীরতর সাক্ষাৎকার ও ব্যাখ্যামূলক ঘটনানির্ভর বিশ্লেষণ ব্যবহার করেছেন।
আর্থিক কষ্ট ও দারিদ্র্য তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের মুখোমুখি হওয়া সমস্যাগুলোকে আরও বাড়ায়। এর ফলে অকালে তাদের অনেককে পড়াশোনা ত্যাগ করতে বাধ্য করে।
যদিও বাংলাদেশ ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০২০ সালে তাদের একটি পৃথক বিভাগে ভোট দেওয়ার অধিকার দিয়েছে। তবে এই আইনি স্বীকৃতিগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্থবহ পরিবর্তনে রূপান্তিরিত হয়নি।
গবেষণায় দেখা যায়, সামাজিক কলঙ্কগুলো গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে, যা তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের জন্য বর্জনের একটি চক্রকে স্থায়ী করে।
পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা
গবেষণায় তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন বা হ্রাস করার ক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উভয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।
অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্ত অভিজ্ঞতাগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, পরিবারগুলোর কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতার অভাব স্কুলগুলোতে বর্জনের মুখোমুখি হওয়ার মতোই ক্ষতিকারক হতে পারে।
পরিবারের সমর্থন ছাড়াই অনেক তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি সামাজিক বাধাগুলো অতিক্রম করতে লড়াই করে। যা তাদের শিক্ষা অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষকদের মতে, প্রান্তিকতার চক্র ভাঙার জন্য সামাজিক ও শিক্ষাগত উভয় পরিমণ্ডলের মধ্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করা অপরিহার্য।
তারা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, কেবল শিক্ষাগত সংস্কারই যথেষ্ট হবে না। বরং তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ, সহায়ক শিক্ষার পরিবেশের সুবিধা নিশ্চিত করতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকারের বৃহত্তর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা প্রয়োজন।
গবেষকরা এমন একটি ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করার জন্য বৃহত্তর বোঝাপড়া, সহানুভূতি এবং নীতি পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন। যেখানে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা বৈষম্যের কোনো হুমকি ছাড়াই সাফল্য অর্জন করতে পারে।
কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ
'এমপ্লয়াবিলিটি অব ট্রান্সজেন্ডার ইন বাংলাদেশ: প্রবলেমস অ্যান্ড প্রসপেক্টস' নামে ফারিহা আবেদিন ও মো. আতিকুর রহমান সরকারের আরেকটি গবেষণা নির্ভর বইয়ে বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে।
তৃতীয় লিঙ্গেরদের যারা তাদের শিক্ষা ও পেশাদার দক্ষতার অভাবের কারণে আনুষ্ঠানিক চাকরির বাজার থেকে মূলত বাদ পড়ে যায় তাদের জন্য সম্ভাব্য সীমিত কর্মসংস্থানের সুযোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ওই গবেষণায়।
প্রতিকূলতার মধ্যেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (এসএমই ফাউন্ডেশন) এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিলের মতো সংস্থাগুলো তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের দক্ষতা ও কর্মসংস্থান উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তাসহ এসব উদ্যোগ তৃতীয় লিঙ্গেরদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের পথ তৈরিতে সহায়তা করছে।
এসব উদ্যোগ কিছুটা আশার আলো দেখালেও সামগ্রিক চিত্র এখনও ভয়াবহ। বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকাংশই অশিক্ষিত, বেকার ও প্রান্তিক রয়ে গেছেন।
গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মধ্যে যারা চাকরি পেতে সক্ষম হন, তারা প্রায়শই ক্যারিয়ারের অগ্রগতির সীমিত সম্ভাবনাসহ শ্রমিক শ্রেণিতে নিযুক্ত থাকেন।
অন্তর্নিহিত সমস্যাটি হলো তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে সামাজিক ধারণাগুলো এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়নি। ফলস্বরূপ, আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে তাদের অবদানকে অবমূল্যায়ন করা হয়।
অন্তর্ভুক্তির পদক্ষেপ
উভয় গবেষণার লেখকরা যুক্তি দিয়েছেন যে, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা যাতে তাদের জন্মগতভাবে নারী কিংবা পুরুষ সহকর্মীদের মতো সমতার ভিত্তিতে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান লাভের সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করার জন্য আরও কিছু করা দরকার।
উদাহরণস্বরূপ, যদিও কিছু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রূপচর্চা শিল্প, আতিথেয়তা ও তৈরি পোশাকের মতো খাতে কাজ শুরু করেছে, তবে এগুলো নিয়মের বাইরে ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
এমপ্লয়াবিলিটি স্টাডিতে অংশগ্রহণকারীরা একটি সাধারণ আবেদন জানানো হয়েছে। আর তা হলো- তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক আচরণ করা, সুযোগ দেওয়া ও সমাজের পূর্ণ সদস্য হিসেবে বসবাস ও কাজ করার অনুমতি দেওয়া।
তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচিত একজন উত্তরদাতা মর্মস্পর্শীভাবে বলেছিলেন, "দয়া করে, আমাদের সুযোগ দিন, আমাদের আশা ও সম্মান দিন। আমাদের আলোকিত হতে দিন। আমরা আপনার মতোই স্বাভাবিক। আমরা অবশ্যই কাজ করতে পারি এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারি।"
গবেষণাটি শিক্ষা থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান পর্যন্ত তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট প্রয়োজনকে তুলে ধরে এমন লক্ষ্যযুক্ত নীতি তৈরির গুরুত্বের ওপর জোর দেয়।
বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গেরদের আনুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও গবেষকরা জোর দিয়ে বলছেন, প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য শুধু আইনি স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়।
তারা তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে সরকার, নীতিনির্ধারক এবং নাগরিক সমাজকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে।
পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ
গবেষণায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনের দীর্ঘ পথটি তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা শিক্ষা ও অর্থনৈতিক জীবনে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করতে পারে।
বিদ্যমান উদ্যোগগুলো উৎসাহব্যঞ্জক হলেও তা এখনও যথেষ্ট নয়। সত্যিকারের পরিবর্তন সাধনের জন্য, সমাজকে অবশ্যই বিদ্যমান পক্ষপাতিত্বকে মোকাবিলা করে দেশের উন্নয়নে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অবদান রাখার সুযোগ করে দিতে হবে।