বাংলাদেশের ‘প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কূটনীতিকের’ অগ্নিপরীক্ষা
নিজের বাকি সাত ভাইবোনের মতো স্বাভাবিক শৈশব বা কৈশোর ছিল না ওয়ালিদ ইসলামের। কারণ অন্য ভাই বোনদের মতো তিনি ছেলে বা মেয়ে নয়, বেড়ে উঠেছেন হিজড়া পরিচয়ে।
ওয়ালিদের মনে আছে, ছোটবেলায় হিজড়ারা তাকে অনেকবার বাড়ি থেকে হিজড়া পল্লীতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
যতবারই হিজড়ারা ওয়ালিদকে ধরে নিয়ে যেত, তার ট্রাক ড্রাইভার বাবা তার মায়ের স্বর্ণের চুড়ি সাথে নিয়ে খুঁজতেন তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। অভাবের সংসারে মুক্তিপণের এই স্বর্ণের চুড়িজোড়াই ছিল তাদের আদরের সন্তানকে কাছে রাখার একমাত্র অবলম্বন।
ওয়ালিদের বাবা-মা উদ্বিগ্ন থাকতেন, তাদের সন্তান যদি হিজড়া পল্লীতে বড় হয়, তাহলে অন্য ছেলেমেয়েদের মত সাধারণ জীবন পাবে না। এজন্য সন্তানকে আগলে রাখতে এবং তাকে একটি সুন্দর জীবন উপহার দিতে চেষ্টায় কোনো কমতি রাখেননি তারা।
ট্রাকচালক বাবা আর্থিক সামর্থ্য না থাকলেও কষ্ট করে শহরের ভালো স্কুলে পড়িয়েছেন ওয়ালিদকে।
স্কুলের নিজস্ব বাস থাকায় সবসময় বাসেই যাতায়াত করত ওয়ালিদ। এতে করে স্কুল যেতে-আসতে কম মানুষের সাথে দেখা হতো। শুধু সন্তানের কারণেই পুরো পরিবার গোপালগঞ্জ থেকে যশোরে চলে আসে, কারণ সেখানে তাদের পরিচিত মানুষজন কম।
উচ্চ মাধ্যমিকের পর ওয়ালিদ ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি)। দমবন্ধ জীবনে এখানে এসে একটু হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন তিনি।
জাবিতে ছেলে শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হলেও অনেকেই ওয়ালিদের লিঙ্গ পরিচয় জানত। তবে এজন্য বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি তাকে।
স্নাতক শেষ করার পর ৩৫ তম বিসিএসে হিসেবে পররাষ্ট্র ক্যাডারে নিয়োগ পান তিনি। ওয়ালিদ বাংলাদেশের প্রথম হিজড়া ক্যাডার অফিসার এবং বিশ্বের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কূটনীতিক।
বর্তমানে তিনি কর্মরত আছেন ইরানে।
ওয়ালিদকে কেউ কেউ জানতো তৃতীয় লিঙ্গের হিসেবে, কেউ বা ছেলে হিসেবেই। তবে এতদিন নিজের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন ছিলেন না তিনি।
কিন্তু সম্প্রতি সাইবার বুলিংয়ে বিরক্ত হয়ে গত ১০ জানুয়ারি ওয়ালিদ তার ফেসবুক পেজে নিজের তৃতীয় লিঙ্গের জীবনের কষ্টের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে ওয়ালিদ লেখেন, 'ধরুন আপনার খুব কাছের বন্ধু/বড়ভাই বা ছোটভাই যে তৃতীয় লিঙ্গের ছিল আপনি তা জানতেন না। অথচ, লেখাপড়া করার সময় আপনি একই হলের, একই রুমে এমনকি একই বেডে শুয়েছেন। যখন জানবেন, তখন আপনি নিজেকে নিজে ঘৃণা করবেন এবং মুখরোচক গল্প বলা শুরু করবেন যে, "এজন্যই ও আমাকে স্পর্শ বা ব্যাড টাচ করার চেষ্টা করছিল, রাতের বেলায় গায়ে হাত-পা তুলে দিত, চুমা দিয়েছিল কয়েকবার", যার কোনোটাই সত্য নয়।
'আপনাদের কাছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ মানেই হচ্ছে সম্পূর্ণ কামুক ও ব্যক্তিত্বহীন মানুষ, কেবলই হাসির খোরাক এবং যাকে ইচ্ছে করলেই সেক্সুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যা-ও দুই-একজন পরিচয় গোপন করে আপনাদের সাধারণ মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে, তারা হয় আপনাদের হাসির খোরাক হয়, নাহয় হয় আপনাদের বুলিং করার বস্তু। আর এই বুলিংয়ের জন্য তারা ক্লাসবিমুখ হয়ে পড়ে, রেজাল্ট খারাপ করে। আমার ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছিল। আর আমি এ কারণেই নিজের লিঙ্গপরিচয় গোপন রেখেছিলাম এতদিন।'
স্ট্যাটাসে ওয়ালিদ জানান, তিনি জাবির সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষকের কাছেও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। তিনি লেখেন, 'আজকের পর থেকে আমাকে নিয়ে অনেক মুখরোচক গল্প ছড়াবে, অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলবে, যারা এতদিন বলে এসেছে আমাকে শ্রদ্ধা করে তারা শ্রদ্ধাবোধ হারাবে। চায়ের দোকানে মুখরোচক গল্প বসবে। এটা জানার পরে যেমনটি করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের জার্নালিজমের শিক্ষক শেখ আদনান ফাহাদ। এসব কিছু সয়ে গেলেও কষ্ট পেয়েছিলাম এটা ভেবে যে শেখ আদনান ফাহাদ একজন শিক্ষক, তিনি আসলে কী শিক্ষা দিচ্ছেন তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমার প্রশ্ন জাগে। এবং তার পোস্টে কমেন্ট করেছে, হাসাহাসি করেছে আমারই ক্যাম্পাসের কাছের সিনিয়র এবং জুনিয়র।
ওয়ালিদ জানান, প্রশিক্ষণের সময়ও প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে ঠাট্টা-বিদ্রুপও সহ্য করতে হয়েছে তাকে। তিনি লেখেন, 'একজন ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর আমার এক ব্যাচমেটের কাছে দাবি করেছিলেন যে আমি তার সাথে সেক্সুয়াল রিলেশনে যেতে ইনিয়ে-বিনিয়ে তাকে প্রস্তাব করেছিলাম। আবার এই প্রতিষ্ঠানের কিছু অপকর্ম নিয়ে কথা বললে আমাকে গে দাবি করে আমার হাঁটাচলা, কথা বলার ধরন নিয়ে ৪০ মিনিটের একটা ক্লাস নেওয়া হয়েছিল আমাকে নিয়ে সি সেকশনে। বলা হয়েছে আমি নাকি ট্রেইনি ছেলেদেরকে হ্যারাস করতাম।'
তবে শুধু পড়াশুনা নয়, প্রেমেও পড়েছিলেন ওয়ালিদ। তবে সে স্মৃতি এত সুখকর নয়। আট বছর প্রেম করার পর ওয়ালিদ যখন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন দুই পরিবার থেকে লিঙ্গ রূপান্তর অস্ত্রোপচার করে মেয়ে হতে বলা হয় তাকে। কিন্তু অস্ত্রোপচারটি ব্যর্থ হয় এবং কোলন ক্যান্সারের মতো জটিলতা দেখা দেয়।
পরে একজন ট্রান্সজেন্ডারকে বিয়ে করতে পারবেন না, এই অজুহাতে ওয়ালিদকে ছেড়ে আরেকজনকে বিয়ে করেন ওয়ালিদের সঙ্গী।
অসম্পূর্ণ অস্ত্রোপচারের কারণে লিঙ্গ পরিচয় হারান ওয়ালিদ।
তিনি লেখেন, 'বিয়ের পূর্বে আমার অন্তত একটা অলিখিত লিঙ্গ পরিচয় (সেক্সুয়্যাল আইডেন্টিটি) ছিল। সবখানে লিঙ্গ হিসেবে "পুরুষ" উল্লেখ করা থাকলেও এখন আমি নিজেই বুঝতে পারিনা আমার আসল পরিচয়টা কী! কারণ এখনও ব্রেস্ট, ভোকাল আর ফেস ফেমিনাইজেশন (ফিলার দিয়ে) সার্জারি বাকি আছে আমার।'
ওয়ালিদ আরও লেখেন, 'যখন বড় তিনটা অপারেশন করতে হলো, তখন ঘুমের ওষুধ নিয়ে আমাকে শুয়ে থাকতে হয়েছিল ৩৬টা দিন। এ সময় আমাকে দেখভাল করতে থাকা একজন আমার নগ্ন শরীরের ছবি তুলেছিল এবং সেই ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আমাকে কয়েকবার ধর্ষণ করেছিল। ব্যাপার না, আমি যেহেতু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, আমাকে যেভাবে খুশি সমাজের মানুষ ব্যবহার করতেই পারে।'
ওয়ালিদ লেখেন, 'নিজের সাথে নিজে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ক্লান্ত আমি। তাই ঢাকঢাক গুড়গুড় ভাব নিয়ে আর কত দিন? হয়তো আমাকে এখানে মানায় না, আমার অবস্থান হওয়ার কথা ছিলো হিজড়া ডেড়ায়। …হয়তো এই ভদ্র মানুষের সমাজ আমার জন্য নয়।'
ওয়ালিদ লেখেন, তিনি এখন আর কারও দয়া বা সহানুভূতি চান না, চান শুধু পারস্পরিক শ্রদ্ধা।
তিনি লেখেন, 'তৃতীয় লিঙ্গের সবাই মানুষ। তাদের সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার আপনারাই করেন।'
'আপনি যে পথ পাড়ি দিয়েছেন আমিও সেই একই পথ পাড়ি দিয়েছি। তবে, আপনার পথে ফুল বিছানো থাকলেও আমার পথে বিছানো ছিল জ্বলন্ত কয়লা। কাজেই আমি মিউচুয়াল রেস্পেক্ট আশা করব, সিম্প্যাথি নয়,' লেখেন ইনি।
ওয়ালিদের স্ট্যাটাস নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে তুমুল আলোচনা তৈরি হয়েছে; অনেকেই ওয়ালিদকে সমর্থন দিচ্ছেন। তবে মন্তব্যের ঘরে কিছু হুমকি ও ব্যঙ্গও দেখা গেছে কিছু।