যে কারণে কালো হয়ে যাচ্ছে ঢাকার নদীগুলো
তৈরি পোশাক উৎপাদনে বিশ্ব বাজারে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। ২০১৯ সালেই ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছি আমরা। কাপড় তৈরি, রঙ করা থেকে শুরু করে সমস্ত প্রক্রিয়া শেষে সুন্দর কাপড় জামা শোভা পায় ইউরোপ-আমেরিকার সুসজ্জিত সব দোকানে।
প্রতি ঋতুতে ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে কাপড়ের রঙের ট্রেন্ডও বদলে যায়। ক্রেতারা রঙের ট্রেন্ড নিয়ে ভাবেন। কিন্তু খুব কম লোকই আছেন যারা এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের কথা উপলব্ধি করতে পারেন।
বিশ্বে শিল্প-কারখানার কারণে হওয়া পানি দূষণের এক-পঞ্চমাংশের জন্য দায়ী ফ্যাশন বা তৈরি পোশাক খাত। এর জন্য দায়ী বাংলাদশের মতো গার্মেন্টস শিল্পপ্রধান দেশগুলো। এই কারখানাগুলোতে রঙ, লবণ, ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য ও ধাতুমেশা তরল সরাসরি নদী বা খালে ফেলা হয়। এতে করে শুধু প্রাকৃতিক জলাশয়ই দূষিত হচ্ছে তা নয়, বরং সেই দূষণ মিশে যাচ্ছে খাবার পানির উৎসে যা ঝুঁকির মুখে ফেলছে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদের স্বাস্থ্যও।
বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এর পক্ষ থেকে বলা হয় যে, 'তৈরি পোশাক খাতের মতো দেশের সর্ববৃহৎ রফতানি খাতগুলোর মাধ্যমে পরিবেশ দূষণের মাত্রা তারা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে।'
সিএনএনকে পাঠানো এক ইমেইলে মন্ত্রী শাহাবউদ্দিন বলেন, এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা কার্যকর করা, দূষণকারীদের উপর জরিমানা আরোপ, পানির মান পর্যবেক্ষণ করা, কেন্দ্রীয়ভাবে পানি পরিশধনাগার স্থাপন, আর পানি পরিশোধনের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে ঢাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে নিরাপদ বিশুদ্ধ খাবার পানি ও বিনামূক্যে চিকিৎসা সেবা দেয় বেসরকারি সংস্থা 'আগ্রহ'। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেদওয়ানুল হক বলেন, এই ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য এক মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার নদীগুলোর পাড়ে গড়ে ওঠা পোশাক কারখানাগুলো থেকে নির্গত রঙ আর তরল বর্জ্য মিশে নদীর পানি পরিণত হয়েছে 'কয়লার মতো কালো' তরলে। এই তরল 'আলকাতরার মতো ঘন আর কালো' এবং শীতকালে যখন বর্ষার মতো পানির প্রবাহ থাকে না, এর প্রচণ্ড দুর্গন্ধ নাকে পাওয়া যায়।
সাভারে গত পাঁচ বছর ধরে থাকেন ৫৫ বছর বয়সী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি। সিএনএনকে তিনি জানান, তার দুই সন্তান আর নাতিরা এখানে তার সঙ্গে থাকেন না, কারণ এই পরিবেশে বেশিদিন থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়ে তারা।
পোশাকের রঙ কতটা ক্ষতিকর:
এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি প্রতি বছর ৯৩ বিলিয়ন ঘনমিটার বা ২১ ট্রিলিয়ন গ্যালন রঙ ব্যবহার করে কাপড় রঙ করতে। এই পরিমাণ রঙ দিয়ে অলিম্পিকের ৩৭ মিলিয়ন সুইমিং পুল ভরে ফেলা সম্ভব।
এই তো গেল কাপড় রঙ করার বিষয়। এরপর আছে কাপড়ের 'ফিনিশিং'। ফিনিশিং হল কাপড়ে পছন্দমতো ফিনিশিং হলো কাপড়ে পছন্দমতো মসৃণতা বা খরখরে ভাব আনতে আরও রাসায়নিক উপকরণ দেওয়া হয়। যেমন ব্লিচিং, সফেনিং বা মোলায়েমকরণ, কাপড় পানি নিরোধক বা ভাঁজ নিরোধক করা ইত্যাদি। কাপড়ে এই বৈশিষ্ট্যগুলো আনতে প্রচুর পরিমাণে পানি আর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যাতে করে বারবার ধোয়ায় কাপড়ের রঙ আর কৃত্রিমভাবে আনা এই বৈশিষ্ট্যগুলো হাল্কা না হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে ডেনিম বা জিন্সের কথা ধরে নেওয়া যাক।
জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কাচামাল থেকে সুতা তৈরি করা শুরু করে একটা জিন্সের প্যান্ট বানাতে সাড়ে সাত হাজার লিটার পানি লাগে।
জিন্সের যে নীল রঙ আমরা দেখি, সেটা টেকসই করতে সুতা বা কাপড়কে কৃত্রিম্ভাবে তৈরি নীল রঙে বারবার ডোবানো হয়। রঙ করার পর দেনিম কাপড়কে আরও রাসায়নিক ব্যবহারে নরম করা হয় বা এর গায়ে খসখসে ভাব আনা হয়। আমরা যে রঙ জ্বলা জিন্স ট্রেন্ড দেখি, সেই রং-জ্বলা জিন্স তৈরি করতে তো আরও প্রচুর রাসায়নিক প্রয়োজন। এইসমস্ত রাসায়নিকের মধ্যে আছে এসিড, এনজাইম, ব্লিচ এবং ফরলডিহাইড।
কিন্তু কেবল জিন্স নয়, প্রতিবেশ দূষণের জন্য দায়ী ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির আরও অনেক বিষয়।
টেলিফোনে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চীনের শীর্ষ পরিবেশবিদদের একজন মা জুন বলেন, 'প্রতি সিজন বা ঋতুতে ফ্যাশন জগত নতুন এক বা একধিক রং নিয়ে কাজ করে, সমস্ত দোকানে ততখন ওই রঙের কাপড় চোপড় দেখা যায়। পরবর্তী ঋতুতে সেটা পালটে যায়, আবার নতুন একসেট রঙ নিয়ে কাজ করে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। এভাবে প্রতিবার নতুন নতুন রঙ নিয়ে কাজ শুরু হয় আর সেই রঙ আনার জন্য আরও নতুন ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার শুরু হয়।
যখন এই রঙের ব্যবহার শেষ হয়ে যায়, কারখানাগুলো থেকে এই কেমিকেল মেশানো দূষিত তরল ফেলা হয় কাছাকাছি থাকা নদী কিংবা খালে। তারা কোন ধরনের বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা রাখে না, কারণ এতে খরচ অনেক বেড়ে যায়। তাই খরচ বাঁচাতে পরিবেশের ক্ষতি করে যাচ্ছে এভাবে দিনের পর দিন।
রাসায়নিকের কারণে পানি কালো, দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যায় কেন:
জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদন বলছে, শুধুমাত্র তৈরি পোশাক শিল্পকারখানা থেকেই ৭২ রকমের ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত হয় যা পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে। এই সমস্ত রাসায়নিক পানিতে মেশার ফলে পানি এত ভারি আর ঘন হয়ে যায় যে নদী বা খালের তলদেশে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে না। ফলে এইসমস্ত জলাশয়ে জলজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে না। অর্থাৎ পানিতে অক্সিজেন উৎপন্ন হয় না। আর এই অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় সমস্ত জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী।
ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশ্রিত পানি অনেক সময় জমিতে ফসল সেচের জন্য ব্যবহার করা হয়। এতে করে খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে আমাদের শরীরে ঢুকে পড়ছে এইসমস্ত ক্ষতিকর উপাদান।এক গবেষণায় সাভারের আশাপাশের এলাকায় উৎপন্ন সবজিতে কাপড়ের রঙের মতো রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এইসমস্ত কেমিকেলের কারণে হতে পারে ক্যান্সার ও ত্বকের ভয়াবহ রোগের মতো নানা শারীরিক অসুস্থতা।
এশিয়ার পোশাক কারখানার আধিক্য:
শুধু ঢাকা কিংবা বাংলাদেশ নয়, এই অবস্থা চীন, ভারত, ভিয়েতনামসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও। এর অন্যতম কারণ এই অঞ্চলের স্বস্তা শ্রমবাজার। এখানে শ্রমের দাম অনেক কম। কম টাকায় উন্নত মানের কাপড় তৈরি করিয়ে নেওয়া যায়।
ঢাকার নদীগুলোর মতো চীনের অনেক নদী আর খালও এতটাই দূষিত হয়েছে যে সেগুলো রীতিমতো মরে গেছে বলে জানান চীনের পরিবেশবিদ মা জুন।
একই অবস্থা ভারত, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতেও।
বিশ্বের অধিকাংশ পোশাক কোম্পানি, ব্র্যান্ড ও পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানই টেকসই উন্নয়নের বিষয়টিকে গুরুত্ব নিয়ে বিবেচনা করছে না। সকল পোশাক কারখানায় বর্জ্য পরিশোধনাগার থাকা অত্যন্ত জরুরি।
এছাড়াও প্রতিবছর যে পরিমাণ কাপড় ও পোশাক উৎপন্ন হয় তাও এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। গবেষণা বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাকের চাহিদা বাড়বে ৬৩% পর্যন্ত অর্থাৎ বছরে ১০২ মিলিটন টন কাপড় উৎপাদন হবে। এই হারে কাপড় উৎপাদন হতে থাকলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
- সূত্র: সিএনএন