যে প্রশ্নের উত্তর সবার আগে জানা দরকার; টিকা কী মহামারীর অবসান ঘটাবে?
চলতি ডিসেম্বরের শুরুতে কোভিড-১৯ টিকাদানের এক ব্যতিক্রমী পরিকল্পনা ঘোষণা করে দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া। অন্যদের মতো বয়োবৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ন্যায় ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী নয়, বরং দেশটি ১৮-৫৯ বছরের সকল নাগরিককে টিকা দিতে চায়।
দেশটির এ পদক্ষেপের পেছনে অবশ্য বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে। ঝুঁকিগ্রস্তদের প্রাণ বাঁচানোর চাইতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সারা দেশ থেকে সংক্রমণ নির্মুলে। আর অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিতে থাকারাই যেহেতু নিজেদের অজ্ঞাতে জীবাণু ছড়ানোর কাজটা করেন, তাই তাদের টিকার আওতায় আনলে জীবাণুর বিস্তার পাওয়ার সুযোগও হ্রাস পাবে। পাশপাশি তরুণ ও মধ্যবয়স্কেরা জনসমাগম স্থলে ভিড় করেন কাজে বা অবসর কাটাতেও। তাদেরকে সুরক্ষিত করা গেলে ধীরে ধীরে মহামারীতেও ভাটা পড়বে।
এসব কথা তুলে ধরে জাকার্তা ভিত্তিক এইকমান ইনস্টিটিউড ফর মলিক্যিউলার বায়োলজির পরিচালক ও জীববিজ্ঞানী আমিন সোয়েবান্দ্রিও জানান, "আমরা টিকার মাধ্যমে হার্ড ইম্যিউনিটি তৈরির লক্ষ্য নিয়েছি।"
কিন্তু, ইন্দোনেশিয়ার পরিকল্পনাটিতে একটি বড় কমতি রয়েই গেছে; কারণ কেউই জানে না বাজারে প্রথম দিকে আসা কোভিড-১৯ টিকাগুলো আদৌ হার্ড ইম্যিউনিটি বা গোষ্ঠীবদ্ধ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারবে কিনা। এপর্যন্ত নানা ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার ট্রায়ালে দেখা যায়, টিকাপ্রাপ্তরা অসুস্থতা থেকে রক্ষা পান, কিন্তু তার মানে এই নয় যে; ভাইরাস তাদের শরীরে আশ্রয় নিতে পারে না, বা তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে পারে।
এই পার্থক্য প্রায়শ'ই নীতি-নির্ধারক মহলেও উপেক্ষিত হয়। তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, মহামারীর দীর্ঘমেয়াদী গতিপ্রকৃতি এর উপরই নির্ভর করছে। শুধু ইন্দোনেশিয়া নয়, পুরো পৃথিবীর জন্যই তা সমান প্রভাব ফেলবে। দৈব-ওষুধের মতো টিকা মহামারীর সম্পূর্ণ অবসান করবে বলে যে গল্প বলা হয়; তা আসলে অর্ধসত্য। স্বাভাবিক জীবন টিকাদান সম্পন্ন হলেই ফিরে আসবে, এটাও অনেকটা মন্দের ভালোর মতো আশ্বাসের বাণী। প্রকৃতপক্ষে টিকাগুলো তেমন ক্ষমতা সম্পন্ন কিনা- তা এখনও স্পষ্ট নয়।
জাদুর আধার নয় টিকা:
চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বলে পরিচিত টিকা। মানুষের ধারণার চাইতেও তারা অনেক জটিল প্রক্রিয়ায় কাজ করে। সর্বোত্তম টিকাগুলো নির্দিষ্ট জীবাণুকে শনাক্ত করে তাকে ধ্বংস করে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়; গুটিবসন্ত এবং হামের টিকার কথা। প্রথম রোগটিকে প্রায় নির্মুল করতে পেরেছে প্রতিষেধক। আর খুব শিগগির দ্বিতীয় রোগের ক্ষেত্রেও এমন সফলতা পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
এই সফলতার একটি বড় কারণ হচ্ছে, টিকাগুলো এক ধরনের জীবাণুরোধক সুরক্ষা দেয়। একে বলা হয়, স্টেরিওলাইজিং ইম্যিওনিটি অর্থাৎ, টিকাগ্রহণকারী রোগের উৎস ভাইরাসে আক্রান্ত হয় না বা সেগুলো ছড়াতেও সাহায্য করে না। এইভাবে জনসমষ্টির সিংহভাগ অংশকে যখন টিকার আওতায় আনা হয়, কেবল তখনই মেলে হার্ড ইম্যিউনিটি। সোজা কথায়, তখন ক্ষতিকর জীবাণু কোনো বাহক দেহ খুঁজে পায় না এবং ধীরে ধীরে তার প্রাদুর্ভাব বিলুপ্ত হয়।
তবে গুটিবসন্ত ও হামের টিকা আজকের অবস্থানে এসেছে কয়েক দশকের গবেষণার হাত ধরে। কোভিড-১৯ টিকা তৈরি হয়েছে রেকর্ড সময়ে এক বছরেরও কম সময়ে। তাই রয়ে গেছে অনেক অজানা সম্ভাবনা ও শঙ্কা। একটি স্টেরিওলাইজিং কোভিড টিকা প্রস্তুতে আগামী দশক লেগে যাওয়াটাও অসম্ভব নয়।
কোভিড-১৯ ও এক ধরনের ফ্লু'র জীবাণু, যা টিকাগ্রহণকারী কিছু ব্যক্তির দেহেও বাসা বাধতে পারে। আশ্রিতদেহে কোনো উপসর্গের জন্ম না দিয়েই জীবাণুটি শুধু উপযুক্ত পরিবেশে অন্য পোষক দেহে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজতে পারে। আর এমন সংক্রমণে নিঃসন্দেহে যারা টিকা পাননি তেমন মানুষের জীবন সংশয়ের ঝুঁকি থাকবে অনেকগুণ বেশি।
চালান পাওয়ার গতির উপর নির্ভর করছে মোট জনসংখ্যার কতবেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে- সেই বিষয়টি। যতদিন সকলে টিকা না পাবেন- ততদিনে চটজলদি গবেষণার নয়া টিকা জীবাণু বিস্তার রোধ করতে যে ব্যর্থ হবে, সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। বিশেষ করে, কোভিড-১৯ এর মতো ফুসফুসের ব্যাধিতে এ সংক্রামক শক্তি মারাত্মক বলেই জানান তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল ভিত্তিক ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডোবোমির দিমিত্রভ বলেন, "কত তাড়াতাড়ি আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব, সেটা অনুমান করাটাও এই মুহূর্তে বেশ কঠিন। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট; দেশভেদে তা আলাদা আলাদা হবে। আঞ্চলিক ভেদাভেদও যতদিন যাবে ততো স্পষ্ট হবে। টিকা পাওয়া আর না পাওয়ার এই বৈষম্যই আগামীদিনে নতুন স্বাভাবিকতায় রূপ নেবে।"
এ অবস্থায় তিনিও অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের ন্যায় টিকার সুবিধা বঞ্চিতদের নিয়মিত মাস্ক ও গ্লোভস পড়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণের জোর তাগিদ দেন।
- সূত্র : ডিসকভার ম্যাগাজিন