রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় যে বাড়িতে থাকতেন, সেটির মালিক এখন দুই বাঙালি!
১৯০৬ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের আর্বানায় 'অ্যাগ্রিলাকালচার ইকনোমিক্স' নিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন রবীন্দ্রনাথও সেখানে গিয়েছিলেন কয়েক দিনের জন্য।
এরপর ১৯১২ সালে তিনি আবার আর্বানায় যান। থাকেন টানা ছয় মাস; ১৯১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯১২ সালের ২৭ অক্টোবর নিউইয়র্কে নামেন কবি। সেখান থেকে ট্রেনে যান শিকাগো। তারপর ঘোড়ার গাড়িতে পৌঁছান আর্বানা।
সে বছরের ৭ নভেম্বর কবি তার ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লিখেন, 'ভাই জ্যোতিদাদা, আমরা আমেরিকায় এসে পৌঁছেছি। সে কারণে তোমার চিঠি আসতে দেরি হয়েছে।... আমরা একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। বৌমা সেই বাড়ির কর্ত্রী। তাকে নিজেই রান্না করতে হচ্ছে।' চিঠির উপরে ঠিকানা লেখা, '৫০৮ হাই স্ট্রিট, আর্বানা, ইলিনয়, ইউএসএ।'
এ বাড়িতেই টানা ছয় মাস কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আর্বানা-শ্যাম্পেনে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরে থাকা সেই বাড়ি এত বছর পর কিনে নিয়েছেন কাজল মুখোপাধ্যায় ও মৌসুমী দত্ত রায় নামে দুই ভারতীয় বাঙালি।
জানা যায়, ওই বাড়িতে কবির নোবেলজয়ী 'গীতাঞ্জলি'র ইংরেজি অনুবাদ লেখা হয়েছিল। ওখানে বসেই তিনি কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস-সহ একাধিক প্রখ্যাত ব্যক্তিকে প্রচুর চিঠি লিখেছেন। ওখান থেকেই পড়াতে গিয়েছেন হার্ভার্ডে। গেছেন আইওয়া-শিকাগোতেও।
যেমন বাড়ি, যেভাবে কেনা...
ইংল্যান্ডের পুরনো বাড়ির ধরনে তৈরি সাদা রঙের বাড়িটি দোতলা। ভেতরটাও সুন্দর বলে দাবি কাজল-মৌসুমীর। 'একটা পুরনো পুরনো ব্যাপার লেপ্টে আছে বাড়িটার সঙ্গে। নিচে তিনটে আর উপরে তিনটে করে ঘর। রবীন্দ্র-সময়কার অনেক জিনিসপত্রও আছে। বাথটাবও,' বলেন কাজল।
মৌসুমী বলেন, "আফগানিস্তানের ঘটনার পর সেদিন জার্মান চ্যান্সেলরকে দেখলাম, 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য' আবৃত্তি করছেন। মনে হলো, দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ এখনো কত প্রাসঙ্গিক এই পশ্চিমে! গোটা বিশ্বে। অথচ বাঙালি তার মূল্যায়ন করতে পারেনি এখনো। এমনকি, পুব-পশ্চিমের সেই যোগসূত্রও এখন ছিন্ন। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে পুরনো সেই যোগসূত্র ফের জুড়তে চাই আমরা। তাই বাড়িটা নিয়েছি।"
জানা যায়, ১৯০৩ সালে তৈরি আর্বানার ওই বাড়ি কিছুদিন আগ পর্যন্ত ছিল স্ট্যান শার্লো নামে সত্তরোর্ধ্ব এক আমেরিকান ভদ্রলোকের মালিকানায়। বহু চেষ্টায় কাজল ও মৌসুমী তাকে বাড়ি বিক্রিতে রাজি করাতে পেরেছেন।
নিউইয়র্ক থেকে কাজল বলেন, 'বৃদ্ধ প্রথমে রাজি ছিলেন না। তিনি রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ হলেও বাড়িটির ঐতিহ্যের ব্যাপারে খুব যে যত্নশীল ছিলেন, তেমন নয়। আমরা অনেক দিন ধরেই অনুরোধ করছিলাম। শেষে শার্লোর ছেলে তার বাবাকে রাজি করান। বোঝান, বাঙালিদের কাছে এ বাড়ি থাকলে ইতিহাসে তিনিও থেকে যাবেন। অবশেষে আমরা বাড়িটা হাতে পাই।'
অবশ্য বাড়িটির দাম প্রকাশ করেননি কাজল।
ছড়িয়ে থাকা স্মৃতি...
ওই বাড়িতে কবিগুরুর বসবাসের নানা স্মৃতির উল্লেখ পাওয়া যায় তার চিঠিপত্রে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত 'সিলেক্টেড লেটারস অব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর'-এ ওই বাড়ি এবং আর্বানার একাধিকবার উল্লেখ রয়েছে।
মৌসুমী বলেন, 'আর্বানাতে একটা টেগোর [ঠাকুর] ফেস্টিভ্যাল হয় প্রতি বছর। চ্যানিংমারে ফাউন্ডেশন আর ইউনিটারিয়ান ইউনিভার্সাল চার্চ তার উদ্যোক্তা। আমরা প্রতি বছর যেতাম। তার আগেই ওই বই থেকে বাড়িটা সম্পর্কে জেনেছিলাম। গেলেই বাড়িটা দেখতাম হাঁ করে। এই বাড়ির সঙ্গে এত ইতিহাস জড়িয়ে! নোবেলজয়ী গীতাঞ্জলি এখানে বসে অনূদিত হয়েছে। একটা শিহরণ জাগত। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা পরিসংখ্যানবিদ অনিল বেরা আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ওকে বলি বাড়িটা কিনে নিতে। তবে শেষমেশ ওর উদ্যোগেই বাড়িটা আমরা পেয়েছি।'
কাজল বলেন, 'বাড়িটা দেখলেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতো। বাঙালির গর্ব তো এই বাড়ি! বাড়িটার কথা তেমনভাবে কেউ জানেন না। রথীন্দ্রনাথ কসমোপলিটন ক্লাব এই বাড়িতে শুরু করেছিলেন। আমেরিকার তৎকালীন লেখক, বিদ্বজ্জনেরা আসতেন এ বাড়িতে। তাদের মধ্যে আলোচনা হতো। সাহিত্যসভা বসত। বৈঠক হতো। রবীন্দ্রনাথের দর্শনকে পশ্চিমে আরও বেশি করে প্রচারের জন্য এই বাড়িটার প্রয়োজন আছে।'
অন্যদিকে, মৌসুমী বলেন, "এ বাড়ি আমাদের নয়, ভারতের সম্পত্তি। রবীন্দ্রনাথ তার 'ছেলেবেলা'য় লিখেছেন, 'বিলেতে গেলেম, ব্যারিস্টার হইনি। জীবনের গোড়াকার কাঠামোটাকে নাড়া দেবার মতো ধাক্কা পাইনি, নিজের মধ্যে নিয়েছি পুব-পশ্চিমের হাত মেলানো- আমার নামটার মানে পেয়েছি প্রাণের মধ্যে।' আমরা সেই দর্শনটাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।''
"এখানে একটা রাইটার্স রেসিডেন্স করার ইচ্ছে আছে। রাস্তাটার নাম 'টেগোর সরণি' করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব। একটা ছোট ফাউন্ডেশনও করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন জিনিস নিয়ে একটা মিউজিয়াম এবং আর্কাইভও করব,'' বলেন কাজল।
-
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা