রাম কুকুর: বাংলাদেশের বিস্মৃত এক বন্যপ্রাণী
ক্যারিশমা, সাহস, দর্প, বীরত্ব বা হিংস্র- এ শব্দগুলো একসঙ্গে শুনলেই অনেকের মানসপটে ভেসে ওঠে বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, ভাল্লুক বা চিতাবাঘের মুখ। তবে এরকমই আরেকটি প্রাণীর কথা হয়তো আমরা অনেকেই ভুলে গেছি- বলছিলাম এশিয়ান বন্য কুকুরের কথা- ইংরেজি নাম এশিয়াটিক ওয়াইল্ড ডগ। আঞ্চলিকভাবে রাম কুকুর, ঢোল নামেও পরিচিত প্রাণীটি।
এশিয়া জুড়ে বিচরণ
বেশ বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এ প্রাণীটির দেখা মেলে। দূর পশ্চিম থেকে কাস্পিয়ান অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পরেছিল প্রাণীটি, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বনাঞ্চলে। জন্ম থেকেই ঢোলের অভিযোজন ক্ষমতা ভাল থাকে, তুলনামূলক কম সুরক্ষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল, এগ্রোফরেস্টে দেখা যায় এদের।
বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশে (পাকিস্তান ছাড়া), ইন্দোচীন, পেনিনসুলার মালেয়শিয়া, দ্য গ্রেটার সুন্দা দ্বীপপুঞ্জ ও দক্ষিণ চীনে ঢোলের দেখা মেলে। সাইবেরিয়া ও উত্তর কোরিয়াতেও ঢোল থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
এখনো বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে এদের বিচরণ দেখা যায়। জ্বি, ঠিকই শুনছেন!
সামাজিক প্রাণি
ক্যানিড পরিবারের প্রাণী হিসেবে ঢোলের মধ্যেও সামাজিকতা দেখা যায়। একদল ঢোলকে ক্ল্যান ডাকা হয়, সাধারণত একটি ক্ল্যানের নেতৃত্বে থাকে একটি নারী ও পুরুষ ঢোল।
একটি ক্ল্যান অনেক বড় হতে পারে, ৪০টি ঢোলও থাকতে পারে একটি ক্ল্যানে। তবে শিকারের জন্য একটি ক্ল্যানের সদস্যদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে শিকার করতে দেখা যায়।
শিসের শব্দ শুনলেই সতর্ক থাকবেন
ঘন বনের ভেতরে টিকে থাকতে ও শিকার করার জন্য ঢোলদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখাটা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়ায়। লেজ নাড়ানো, পরস্পরের মুখ চেটে দেওয়া ছাড়াও, শিস বাজানোর জন্যও পরিচিত এরা। ঘন ঘাসের ভেতর বা ঘন জঙ্গলে এ কৌশলেই পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢোল।
এশিয়ান কোনো বনে ট্রেকিংয়ের সময় শিসের আওয়াজ শুনলেই নিরাপদে থাকবেন যেন। হয়তো আপনিও একটি ক্ল্যানের মুখে পড়ে যেতে পারেন!
জীবিত শিকার খায়!
দিনের বেলাতেই শিকার করে ঢোল। ঢোল শিকার ধরার পর শিকারকে জীবিতই খেয়ে নেয়। শুনতে বীভৎস মনে হলেও, এটি একটি সহজাত বিবর্তনীয় প্রতিক্রিয়া মাত্র।
ক্ষুদ্রদেহী প্রাণী ঢোল, শিকার করে দলবেঁধে। বসবাসের অঞ্চলে থাকে বাঘ চিতাবাঘের মতো প্রাণীও। তাই শিকার ধরা মাত্রই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব খেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে প্রাণীটি।
বাঘকেও প্রতিহত করতে পারে
প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অসম সাহসী হিসেবেই পরিচিত ঢোল। বাঘ এক থাবা দিয়ে ঢোলকে মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু, বাঘের সামনেও ঢোলের পুরো দল হুমকিস্বরূপ।
দীর্ঘ সময় ধরে আক্রমণকারীকে তাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে ভয় দেখানোর ঘটনাও বেশ সাধারণ। কম বয়সী অনভিজ্ঞ বাঘের মৃত্যুও হতে পারে এ ধরনের ঘটনায়।
ঢোলের বিরুদ্ধে বাঘের প্রতিরক্ষার সবচেয়ে উপযোগী কৌশল হলো ভয় পেয়ে পালিয়ে না যাওয়া। নিজের অবস্থানে থেকে শক্তি প্রদর্শন না করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেই ঢোলের দল অবস্থা বুঝে আক্রমণ করে বসে।
মানুষের কর্মকান্ডের ভুক্তভোগী
২১ শতকে এসে প্রজাতিটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। ঢোলদের বাসস্থান উজাড় হয়ে যাচ্ছে। দিনে বিচরণ করায় মানুষের সংস্পর্শে আসার ঘটনা খুব সাধারণ, তবে মানুষকে আক্রমণের বা মেরে ফেলার ঘটনা শোনা যায়না।
প্রকৃতিতে তাদের শিকার করে খাওয়া প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। গবাদি পশু আক্রমণের জন্য তাদের ধরে মেরে ফেলা হয়। বর্তমানে, বন্য পরিবেশে মাত্র দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার ঢোল বেঁচে আছে। দিন দিন এ সংখ্যা কমছেই।
এখনো অবহেলিত
এখনো ঢোল নামের প্রাণীটির সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বাংলাদেশে প্রজাতিটি নিয়ে একটি গবেষণাও নেই। তাদের নিয়ে জানাশোনাও কম, গবেষণাও কম, তাদের প্রতি ভালোবাসাও কম।
একটি বিষয় নিশ্চিত, খুব দ্রুতই নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছে প্রাণীটি।
- লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক ও বন্যপ্রাণি গবেষক
- ভাষান্তর: রাফিয়া তামান্না