শিল্পী শিম্পাঞ্জি, যার ভক্ত ছিলেন স্বয়ং পাবলো পিকাসো!
পাবলো পিকাসো – সর্বকালের সেরা চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের একজন। এই স্প্যানিশ কিংবদন্তিই কিনা ছিলেন অন্য এক শিল্পীর গুণগ্রাহী ভক্ত। এতটাই যে, উপহার হিসেবে পাওয়া সেই শিল্পীর আঁকা একটি ছবি নাকি টাঙিয়েও রেখেছিলেন নিজের ঘরের দেয়ালে!
না, এই দাবির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পিকাসোর ঘরে গিয়ে সত্যাসত্য কেউ খতিয়ে দেখেনি যে! তারপরও এই দাবি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ যে শিল্পীর কথা বলছি, সে কোনো মানুষ নয়।
তবে? কে সে? বিস্ময়কর হলেও সত্য, সে একটি শিম্পাঞ্জী! গালভরা একটি নামও ছিল তার – কঙ্গো।
কঙ্গোর জন্ম ১৯৫৪ সালে। মাত্র দুই বছর বয়সেই ছবি আঁকতে শুরু করে সে। যে মানুষটির কল্যাণে এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল, তিনি প্রাণীবিদ ডেসমন্ড মরিস। পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন চরিত্রবিজ্ঞানী ও পরাবাস্তববাদী শিল্পীও বটে।
নিজের সকল পেশা ও নেশাকে একীভূত করে এক অভূতপূর্ব গবেষণা শুরু করেন। জানার চেষ্টা করেন, মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো প্রাণীর ছবি আঁকার 'শখ' আছে কি না। সেটি জানতেই তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন প্রাইমেট বর্গের প্রাণীদের নিয়ে।
এরই সূত্র ১৯৫৬ সালে, কঙ্গোর বয়স যখন সবে দুই বছর, মরিস তার হাতে ধরিয়ে দেন একটি পেনসিল। আর তার সামনে রাখেন একটি কার্ড। চিড়িয়াখানায় গিয়ে মরিস অন্য সব প্রাণীকে রেখে কঙ্গোকেই বেছে নেন, কেননা তার মনে হয়েছিল, এই শিম্পাঞ্জীটির মধ্যে সেই 'শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব' রয়েছে, যার সুবাদে তাকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা যাবে।
যা-ই হোক, কঙ্গোর হাতে পেনসিল তুলে দেওয়ার পর যা হলো, নিঃসন্দেহে তা ইতিহাস। কার্ডের উপর একটি রেখা আঁকল কঙ্গো, যা তার জীবনের অঙ্কন। কিছুক্ষণ পেনসিলটি ঘুরিয়ে কার্ডের উপর আঁকিবুঁকি কেটে থেমে গেল সে।
মরিস রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন, কী হবে এরপর? কঙ্গো কি থেমে যাবে? তার আগ্রহ কি মিটে গেছে? নাকি সে আরও কিছু আঁকবে?
দেখা গেল, ছবি আঁকার নেশা ভর করেছে কঙ্গোর উপর। একের পর এক রেখা এঁকে চলেছে সে কাগজের উপর। আর শুধু রেখাই বা কেন! অনেক বৃত্তও আঁকছে সে। অর্থাৎ, ছবি আঁকার 'বেসিক নলেজ' তার আছে!
তাছাড়া কঙ্গো স্কেচের দুই ধারের প্রতিসমের ক্ষেত্রেও ধারাবাহিকতার প্রমাণ দিল। মরিস যখন একটি কাগজের একপাশে কোনো একটি আকৃতি আঁকলেন, কঙ্গোও কাগজের অন্যপাশে ভারসাম্য রেখে আরেকটি আকৃতি আঁকল। কিংবা মরিস যখন কাগজের একপাশে নীল রঙ ব্যবহার করলেন, কঙ্গোও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে অন্যপাশেও একই রঙ ব্যবহার করল।
মরিসের জন্য এটি ছিল 'ইউরেকা মোমেন্ট'। তিনি বুঝতে পারলেন, এই শিম্পাঞ্জীটিকে দিয়ে তার কাজ হবে। এবং সত্যিই কাজ হলো। মাত্র অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সে বিভিন্ন আকার-আকৃতি ও প্যাটার্নের ছবি আঁকতে শুরু করল, যেগুলো সে নিজের চোখে কখনও দেখেনি। অর্থাৎ শিল্পকর্মে যে নিজের কল্পনাশক্তির অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে লাগল।
ছবি আঁকতে আঁকতে কঙ্গো নিজের একদমই স্বতন্ত্র একটি 'বিমূর্ত প্রতিচ্ছায়াবাদী' স্টাইল প্রতিষ্ঠা করল। তিন বছর সময়কালের মধ্যে সে প্রায় চারশো ছবিও এঁকে ফেলল।
একটি শিম্পাঞ্জী একের পর এক ছবি এঁকে চলেছে, তা কি আর লোক জানাজানি হবে না? নিশ্চয়ই হবে! গণমাধ্যম লুফে নিল কঙ্গোর ছবি আঁকার কাহিনি। তবে বলাই বাহুল্য, মানবজাতির স্বভাব যেহেতু যেকোনো বিষয়ে দুই ভাগ হয়ে যাওয়া, তাই কঙ্গোর ছবির ব্যাপারেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে লাগল। তবে কঙ্গোর সৌভাগ্য, খারাপের চেয়ে ভালো প্রতিক্রিয়াই বেশি জুটল কঙ্গোর কপালে। হয়তো সে সত্যিকারের প্রতিভাবান শিল্পী ছিল বলেই!
বেশিদিন বাঁচেনি কঙ্গো। ১৯৬৪ সালে ১০ বছর বয়সেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে সে। তার শিল্পীজীবনের আয়ুষ্কাল আরও কম। ১৯৫৯ সাল অবধি মরিসের অধীনে থাকাকালীনই ছবি এঁকেছে সে।
তবে মরিসের দাবি, ছবি আঁকার সেই দিনগুলো আদতেই ছিল কঙ্গোর জীবনের স্বর্ণালী সময়। রঙ-তুলিতে নিজের মনের ভাব সাদা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলাটা তার জন্য ছিল খুবই উপভোগ্য একটি বিষয়। ছবি আঁকার সুযোগ পেলেই তার চোখ-মুখের ভাব বদলে যেত। শরীরী ভঙ্গিতেও আসত উত্তেজনা ও আনন্দের আমেজ। ছবি আঁকা শেষেও অনেকক্ষণ মন ভালো থাকত তার।
কঙ্গো আজ আর নেই তো কী হয়েছে, এই পৃথিবীর শিল্পানুরাগী মানুষেরা কিন্তু ঠিকই মনে রেখেছে তাকে। তার অনেক ছবিই বিক্রি হয়েছে শত-সহস্র ডলারে। অনেক ছবির আবার চোখ কপালে ওঠার মতো দামও উঠেছে। যেমন ২০০৫ সালে এক নিলাম থেকে ২৫ হাজার ডলারে কঙ্গোর তিনটি ছবি কিনে নেন আমেরিকান সংগ্রাহক হাওয়ার্ড কং।
বছর দুয়েক আগে, ২০১৯ সালের শেষদিকে লন্ডনের দ্য মেয়র গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে কঙ্গোর আঁকা ৫৫টি ছবি নিয়ে একক চিত্র প্রদর্শনীও। ছবিগুলোর মালিক ছিলেন মরিস, যার বয়স বর্তমানে ৯৪ ছুঁইছুঁই।
কেন ছবিগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে 'দ্য নেকেড এপ: আ জুওলজিস্ট'স স্টাডি অব দ্য হিউম্যান এনিম্যাল' বইয়ের লেখক মরিস বলেন, "একসময় এই ছবিগুলো আমার জন্য প্রভূত আনন্দ বয়ে এনেছে। এখন আমি চাই অন্য সংগ্রাহকরা বরং ছবিগুলো সংগ্রহ করে সেই আনন্দের স্বাদ লাভ করুন।"