ক্লদ মনের ক্যানভাস
শিশু খেলে যায় বিশ্ব লয়ে আনমনে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। আমরা অবাক হই, শিহরিত হই, সৌন্দর্যের জন্ম দেখে কেঁপে উঠি, ভালো লাগায় আপ্লুত হই। কিন্তু অবাক শিশু নিজের মনে ব্যস্ত, বিশাল ক্যানভাসে মনের মাধুরী মিশিয়ে বিশ্বের পরিচিত রূপকে অজানা রূপে, অদেখা ভাবে নব নব আঙ্গিকে এঁকে যান তিনি।
পদ্মপুকুরের টলটলে জলে হাওয়া খেলে যায়। তিরতির তরঙ্গের নিয়মিত ওঠানামা, পদ্মকুড়ির আলতো কেঁপে ওঠা, সদ্য পাপড়ি মেলা গোলাপি সুন্দরের আকর, জলজ লাজুক লতা আর কারও নজরে আসে না — তার বাদে। তিনি নিজেই দেখেন, উপভোগ করে তৃপ্ত থাকেন না, আমাদের জন্য এঁকে যান একের পর এক ক্যানভাসে জীবন্ত চিত্র, অমর করে রাখেন তার স্বপ্নের পদ্মপুকুরকে।
অবাক শিশুটির নাম ক্লদ মনে।
চিত্রকর্মের অমর ধারা ইমপ্রেশনিজমের পুরোধা, সে আন্দোলনের মনে এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, ইমপ্রেশনিজম নামটাই নেওয়া হয়েছিল তার এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী চিত্রকর্ম থেকে, যার নাম 'ইমপ্রেশন, সানরাইজ' (ফরাসি: আমপেসিওঁ, সোলেই লোভাঁ)।
কিন্তু মনে খুব বেশি পরিচিত নাম প্রকৃতির মাঝে গিয়ে নিসর্গে অবগাহন করে তা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার জন্য। বিশেষ করে তার পদ্মপুকুরের সিরিজটি হয়ে গেছে সুকুমার সুন্দরের অপার খনি। ২৫০টি অতুলনীয় চিত্রকর্ম জগতকে উপহার দিয়েছিলেন মনে। সবই তার পদ্মপুকুর, সেখানের সেতু, ফুল, গাছ, লতা, জল, মেঘ, ছায়া নিয়ে; এদের নাম নাফিয়া (জলপদ্ম)। একই বিষয় মনে হতো আপাতদৃষ্টিতে, কিন্তু আসলেই কি তা-ই? না-কি ২৫০টি ফ্রেমে খোদাই করা হয়েছে ২৫০টি গল্প; জীবনের প্রতিদিনের মতোই, ভীষণ রকম এক, অথচ গভীরভাবে আলাদা।
যাক, সে তুলির আঁচড়, রঙের গভীরতা, নানা স্তরের ব্যবহারের আলোচনা বোদ্ধা এবং খাঁটি শিল্পরসিকদের জন্য তোলা থাক। আমরা যারা সুন্দর পছন্দ করি, জীবনকে ভালোবাসি, সবকিছুর মাঝে ভালো লাগা খুঁজি, তারা ঘুরে আসি খানিকের জন্য প্যারিসের মিউজে দো ল'হঁজাই (অরেঞ্জ মিউজিয়াম) থেকে।
প্রতিদিন নিয়মিতভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইনটি হয় ল্যুভর জাদুঘরে মোনালিসা দেখার জন্য, তার উলটো পাশে আরেক মহাবিখ্যাত জাদুঘর মিউজে দ'হসে, সেখানেও লাখো লোকের সমাগম সারা বছর।
এ দুই প্রবল পরাক্রমশালী সংগ্রহশালার মাঝে অজস্র সম্পদ নিয়েও এ জাদুঘরটি (অরেঞ্জ মিউজিয়াম) থাকে কিছুটা অবহেলার শিকার হয়ে। কিন্তু যারা আসলেই আইফেল টাওয়ার এবং মোনালিসার জন্য বিরক্তিকর হুড়োহুড়িতে না মেতে প্যারিস উপভোগ করতে আসেন, বিশ্বের সকল শিল্পীর মাতৃভূমির আত্মা ছুঁতে চান, তারা ঠিকই খোঁজ নিয়ে আসেন পেইন্টিং জগতের তাজমহল এ জাদুঘরের কথা।
এখানে বিশেষভাবে নির্মিত দুটি ডিম্বাকৃতি কক্ষের দেওয়ালে ঠাঁই পেয়েছে ৮টি বিস্ময় — ক্লদ মনের আঁকা সেই পদ্মপুকুর, কিন্তু বিশাল বিস্তৃত ক্যানভাসে দুর্লভ ডিটেইলে।
অনেক বিশ্বসম্পদ আছে এখানে। সেজান, মাতিস, মদিগিলিয়ানি, পিকাসো, রেনোয়া, সিসলে, স্যুটিন, রুশ্যো — অনেকেরই চোখভোলানো কাজ। কিন্তু দিনের শেষে যেমন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে বাড়ির পাশের নারকেল পাতায় কাঁপতে থাকা চিরল রোদ মনের পর্দা জুড়ে থাকে অবাক ভালোবাসায়, তেমনি সেদিন সবকিছুর পরে মনজুড়ে ছিল সেই ৮টি ক্যানভাস, ৮টি গল্প, ৮টি বর্ণীল সৃষ্টি, ৮টি জীবন।
১৯২২ সালে বিশেষভাবে পুনঃনির্মিত জাদুঘরটির এ দুই ডিম্বাকার কক্ষের দেওয়ালে স্থাপনের জন্য ক্লদ মনের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয়। তার পরামর্শক্রমে দেওয়ালের গড়ন, আলোর আসার পথ ইত্যাদি ঠিক করার পর কথা ছিল, সে বছরেই মনে তার বিশাল ক্যানভাসগুলো সমাপ্ত করে জাদুঘরে দেবেন।
কিন্তু অজানা কোনো কারণে চিরতরুণ শিল্পী তার প্রাণপ্রিয় শেষজীবনের কাজগুলোকে কখনই হাতছাড়া করেননি। ১৯২৬ সালের ৫ ডিসেম্বর, তার মহাপ্রয়াণের মুহূর্ত পর্যন্ত এ কাজগুলো তার সঙ্গেই ছিল। পরের বছর তা জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়।
রুমের মাঝখানে সোফা, যাতে বসে আপনি হারিয়ে যেতে পারেন সেই অপার সুরমূর্ছনায়, যা ফ্রেমের মাঝে আটকাতে সমর্থ হয়েছিলেন মনে। বলা হয়, শিল্পীজীবনের প্রথম থেকেই এমন বিশাল ব্যপ্তির কাজ করতে চেয়েছিলেন মনে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি অর্থ আর ক্রেতার অভাবে।
তাই শেষজীবনে এসে তার কাজে কদর হবে এ নিশ্চয়তার পর আরেকবার দেখিয়েছিলেন শিল্পীর জাত, চিনিয়েছিলেন নিজের তুলি।
ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত, চোখে ছানি পড়া একজন ৮২ বছর বয়সি মানুষের কতখানি জীবনতৃষ্ণা থাকলে, শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থাকলে, রংতুলির প্রতি মমত্ববোধ থাকলে এমন রঙে আচ্ছন্ন করা যায় জীবনের ক্যানভাস — তা ভেবে আপ্লুত হতে হয় প্রতিটি পেইন্টিং দেখার সময়।
তখন তো তার জগৎজোড়া খ্যাতি, অর্থের চাহিদা নেই, সবকিছুই তার হাতের মুঠোয়। তখনও কেন শিল্পসৃষ্টির এ প্রবল বন্ধুর পথ বেছে নিয়েছিলেন ক্লদ মনে? উত্তরটা সহজ — এ ছিল তার জীবন, এর চেয়ে মহত্তর কোনো উদ্দেশ্য তার হতে পারে না, যেমন হতে পারে না সুখী হওয়ার উপায়।
এইই বলার ছিল আমার অসাধারণ সেই আটটি সৃষ্টি নিয়ে। এখানেই সার্থক ক্লদ মনের তুলির আঁচড়, যা নিয়ে বলা শেষ হবে না কখনোই। যুগ-যুগান্তরে মানুষ তাদের নিয়ে আলোচনা করেই যাবে, অবলোকন করবে বিমূঢ় বিস্ময়ে।