সম্মিলিত চেষ্টায় পাল্টে গেল ২৬ গ্রামের চিত্র
খালের নাম 'পাখিমারা'। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ৫২টি গ্রামের মধ্যে ঘুটাবাছা, নাওভাঙ্গা,গামুরতলা, পূর্বসোনাতলা, নেয়ামতপুর, এলেমপুর, মজিদপুর, ফরিদগঞ্জসহ ১৬টির মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল। খালটি থেকে জুগীর খাল, হাজীর খাল, মজিদপুর খাল, আমিরাবাদ খাল, জোনাব আলীর খালসহ অন্তত ৭টি শাখা ইউনিয়নের আরও ১০টি গ্রামে প্রবাহিত হয়েছে।
খালগুলো মিঠা পানির অন্যতম উৎস। অন্তত ৩০ হাজার মানুষ জীবিকার জন্য এগুলোর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। খালের পানি ব্যবহার করে চাষাবাদ হচ্ছে বিপুল জমি। এক সময়ের দারিদ্র্যক্লিষ্ট গ্রামগুলো এখন অনেকটা সমৃদ্ধিশালী।
নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ১০ গ্রামের ১০ কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫০-৬০ বছর আগে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে 'পাখিমারা' খালের দুই প্রান্তে বাঁধ দেওয়া হয়। জুগীর খালের এক প্রান্ত আন্ধারমানিক নদে মিলেছে। আরেক প্রান্ত মিলেছে পাখিমারা খালে। জুগীর খালই তাদের জীবিকার জোগান দেয়। তাই এই খাল অন্য খালের চেয়ে স্থানীয় কৃষকদের কাছে আলাদা গুরুত্ব বহন করে।
কৃষকরা জানান, প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ জুগীর খাল। কুমিরমারা গ্রামে এটির বিভিন্ন অংশে আড়াআড়ি করে বাঁশের ওপর জাল আটকে দিয়ে প্রভাবশালী কয়েকটি পরিবার মাছ ধরত। দখলদারদের কারণে গ্রামের বাসিন্দারা খালের পানি ব্যবহার করতে পারতেন না। খালের পানি ছাড়া সেচের অন্য ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষা মৌসুমে আমন ছাড়া বছরের বাকি সময়গুলো আবাদ হতো না। ফলে গ্রামগুলোর অধিকাংশ পুরুষ কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যেতেন।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে এভাবেই চলছিল বাঁচার লড়াই। দিনে দিনে গ্রামবাসীরা খালের পানি জমিতে সেচ কাজে ব্যবহারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। শুরু হয় খাল দখলমুক্ত করার লড়াই। সেই লড়াইয়ে সঙ্গী হন কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। প্রায় দুই যুগ পর গ্রামবাসী ও ইউএনও'র সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রভাবশালীদের হাত থেকে দখলমুক্ত হয় জুগীর খাল। খালের পানি ব্যবহারে তখন দেখা দেয় আরেক সমস্যা ।
কৃষকরা জানান, খালের জলকপাটগুলো (স্লুইস গেট) জরাজীর্ণ হওয়ায় জোয়ারের লোনা পানি ঢুকে পড়ত জমিনে। জলকপাট মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে ধরণা দিয়েও কাজ হচ্ছিল না। এবারও এগিয়ে আসেন ইউএনও। খালে বাঁধ নির্মাণে সরকারি তহবিল থেকে তিনি ২৫ হাজার টাকা দেন। গ্রামের মানুষেরাও সাধ্যমতো চাঁদা দেন। এভাবে সংগ্রহ হওয়া ৪০ হাজার টাকা দিয়ে নির্মাণ করা হয় ৩টি বাঁধ।
বাঁধ নির্মাণের ফলে গ্রামগুলোর কৃষিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। প্রায় ৫০০ একর অব্যবহৃত জমিতে এবার দেখা যাচ্ছে সবুজের সমারোহ। স্থানীয় কৃষকেরা আবাদ করেছেন তরমুজ, লাউ, শিম, টমেটো, কপি, মুলা,মরিচ সহ নানা ধরনের সবজি। বোরোর আবাদ হচ্ছে প্রায় ৫০ একর জমিতে। নীলগঞ্জ ইউনিয়ন এভাবে গোটা উপজেলায় কৃষির পাশাপাশি সবজি চাষের মডেল ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
কৃষকরা জানান, খালটি দখলদার মুক্ত করতে ২০০৫ সালে কুমিরমারা গ্রামের প্রবীণ কৃষকরা উদ্যোগ নিয়েও সফল হননি। ২০১৮ সালে কুমিরমারা গ্রামের জাকির গাজী, আবুল কালাম, হেমায়েত গাজীসহ কয়েক যুবক আবারও খাল দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেন। নিজ গ্রামসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষদের খাল উদ্ধারের উপকারিতা বোঝানো শুরু করেন তারা।
কৃষক জাকির গাজী জানান, ২০১৮ সালে তিন গ্রামের শত শত মানুষ বৈঠকে সমবেত হন। সেখানেই খাল উদ্ধারের জন্য গঠন করা হয় নীলগঞ্জ আদর্শ কৃষক শ্রমিক সমবায় সমিতি। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি সুলতান গাজীকে সভাপতি, আবু বকর মৃধাকে সাধারণ সম্পাদক ও জাকির গাজীকে কোষাধ্যক্ষ করে ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
জাকির আরও জানান, এরপর জুগীর খাল উদ্ধারে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি দপ্তরের বারবার ধরনা দিয়েছেন সমিতির সদস্যরা। কিন্তু কাজ হয়নি। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে সদ্য যোগ দেওয়া ইউএনও মুনিবুর রহমান এগিয়ে আসেন। আগস্ট মাসে খাল থেকে দখলদারদের জাল অপসারণে অভিযান চালান তিনি। কিন্তু দখলদাররা কয়েকদিন পর আবারও খালে জাল পেতে পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা ঘটায়। এরপর ইউএনওর উদ্যোগে আরও দুই দফা অভিযান চালানো হয়। সর্বশেষ অভিযানে দখলদারদের প্রতি কঠোর হুশিয়ারিও দেন তিনি। এরপর দখলদাররা আর জাল পাতার সাহস পায়নি।
কুমিরমারা গ্রামের মাস্টার্স পরীক্ষার্থী হেমায়েত উদ্দিন (২৪) জানান, চাকরির চিন্তা না করে তিনি সোজা নেমে পড়েছেন কৃষিকাজে। বাবার দেওয়া জমিতে শুরু করেছেন সবজি ও ফসলের আবাদ। এছাড়া ১০ শতাংশ জমি বন্ধক নিয়ে বোম্বাই মরিচের আবাদ করেছেন। চাষ বাবদ তার খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। বোম্বাই মরিচ থেকে ২ লাখ টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
মজিদপুর গ্রামের লিটন হাওলাদার জানান, একসময় তিনি ঢাকা ও বরিশালে গিয়ে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ করছেন। সবজি চাষাবাদ করে তার অভাব দূর হয়েছে।
সুলতান গাজী জানান, খাল দখলমুক্ত হওয়ার পর এখন কুমিরমারাসহ আশেপাশের আরও কয়েকটি গ্রামের চিত্র বদলে গেছে। অন্যদিকে নীলগঞ্জ আদর্শ কৃষক শ্রমিক সমবায় সমিতির সাফল্য দেখে আশেপাশের কৃষকেরা এর সদস্য হচ্ছেন। সমিতির সদস্য সংখ্যা ৩৪ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৯ জনে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মন্নান জানান, সেচের সুবিধা পেয়ে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের অন্তত ২৬টি গ্রামের ৫ শতাধিক একর জমিতে নতুন করে এবার আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ একর জমিতে বোরোর চাষ হয়েছে। বাকি জমিতে হয়েছে সবজির চাষ। আগে এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে বছরে ১৪ থেকে ১৮ হাজার টাকা আয় হতো। এবার সবজি চাষ করে গড়ে প্রতি বিঘা থেকে অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আয় করার আশা তাদের।
নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন মাহমুদ জানান, সেচ সুবিধা পেয়ে ওই ইউনিয়নের মানুষ কৃষিতে অবিশ্বাস্য সাফল্য পেয়েছে। আগে জমিগুলো অনাবাদি পড়ে থাকত।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুনিবুর রহমান জানান, আমি শুধু আমার ওপর রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি। গ্রামবাসীরাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চরম প্রতিকূলতা জয় করেছেন। সহায়তা পেলে গ্রামের মানুষ তার আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে, নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।