হাজি সালাম মিয়া: বাংলাদেশে বাসমতি কাচ্চিকে জনপ্রিয় করেছেন যিনি
সময়টা ছিল ১৯৭২ সাল। হাজি সালাম মিয়ার বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, তার অসুস্থ বাবা এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। সেইসঙ্গে নিদারুণ আর্থিক সংকটে পড়ে যায় তার পরিবার। ১৯৬১ সালে লালমাটিয়া মহিলা কলেজের ঠিক সামনে, একটি টিনশেড ঘরে জন্ম নেওয়া সালাম মিয়া, খুব বেশিদিন স্কুলে পড়ালেখার সুযোগ পাননি। তার আগেই সংসার চালানোর দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। সালাম মিয়ার নানা ছিলেন একজন পেশাদার বাবুর্চি (রাঁধুনি); তাই সাতপাঁচ না ভেবে, নানার দলেই যোগ দেন তিনি।
"তখন আমার পরিবারের সদস্য ছিল সাত জন। তাই একবেলা খাওয়ার পর, পরের বেলার খাবার জুটবে কিনা তা নিয়ে চিন্তায় থাকতে হতো আমাকে", ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর অভিজাত ধানমন্ডি এলাকায়, ভিক্টোরিয়া কনভেনশন সেন্টারে নিজের ডেস্কে বসে কথাগুলো বলেন সালাম মিয়া।
হাজি সালাম মিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে খ্যাতনামা ও ধনী বাবুর্চিদের মধ্যে একজন। বর্তমানে মোহাম্মদপুরে একটি ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্ট, সালাম'স কিচেন নামে চারটি রেস্টুরেন্ট এবং ধানমন্ডিতে ভিক্টোরিয়া কমিউনিটি সেন্টার নামে একটি কমিউনিটি সেন্টারের মালিক তিনি।
কিন্তু সফলতার পথে সালাম মিয়ার এই দীর্ঘ যাত্রা মসৃণ ছিলনা। শুরুতে রান্নাঘরে থালাবাসন ধোয়া, রান্নার লাকড়ি সংগ্রহ করা, মশলা গুড়া করা, পেঁয়াজ কাটার মতো কাজগুলো করতেন তিনি। সারাদিন কাজ করে দৈনিক ২ টাকা করে পেতেন।
কিন্তু সেই অবস্থা থেকে ছয় বছরের মধ্যেই একজন পেশাদার বাবুর্চি হয়ে ওঠেন তিনি; যেখানে অন্যদের ক্ষেত্রে সাধারণত দশ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যায়, জানালেন সালাম মিয়া। আর এর পেছনের কারণটাও ব্যাখ্যা করলেন তিনি, "রান্না করা আমার নেশা।" তাই রান্না শেখা এবং অবশ্যই দ্রুত শেখার প্রতি আগ্রহ ছিল তার।
১৯৭৭ সালে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে সালাম মিয়াকে ৪০০ মানুষের জন্য রান্নার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেদিন সকালে হেড বাবুর্চি এসে শুধু নির্দেশনা দিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
"কিন্তু পরদিন আমার হাতের রান্না খাওয়ার পর অবাক হয়েছিলেন হেড বাবুর্চি। তিনি আমার রান্না এতটাই পছন্দ করেছিলেন যে আমাকে এসে জড়িয়ে ধরেন। তারপর আমাকে বললেন, আমি একদিন অনেক বিখ্যাত বাবুর্চি হবো এবং তিনি আমাকে দোয়া দিলেন", সেদিনের স্মৃতিচারণ করলেন সালাম মিয়া।
১৯৮১ সালে সালাম মিয়া নিজের ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করেন। তখনকার দিনে একজন বাবুর্চির জীবন খুব আরাম-আয়েশের ছিল না। টাকা বা সম্মান, কোনোটাই এনে দিতে পারেনি এই পেশা। তাই সবকিছু চিন্তা করে, সালাম মিয়া বিদেশে গিয়ে নিজের ভাগ্য বদলানোর সিদ্ধান্ত নেন।
জীবনের মোড় বদলে যাওয়া
১৯৮৯ সালে কুয়েতের অভিজাত এলাকায় একজন শেখ এর বাড়িতে রান্নার কাজ পান সালাম মিয়া। ওই বাড়িতে চার বছর বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেন তিনি।
"কুয়েতে যাওয়ার আগে আমার অবস্থা ছিল দিন আনি, দিন খাই এর মতো। কিন্তু এরপর সবকিছু বদলে যায়। সেখানে আমি মাসিক ৫০,০০০ টাকার মতো বেতন পেতাম। ওই সময়ে পঞ্চাশ হাজার টাকার মূল্য ছিল অনেক বেশি", বলেন সালাম মিয়া।
তখনই সালাম মিয়া সিদ্ধান্ত নেন, দেশে ফিরে নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগাবেন। তাই ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন তিনি।
পরের বছর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে অবস্থিত নতুন একটি কমিউনিটি সেন্টার, প্রিয়াঙ্কা কমিউনিটি সেন্টারের বাবুর্চি নিয়োজিত হন। সেখানে তিনি ১০ বছর কাজ করেন।
নব্বইয়ের দশকে খাবারের ব্যবসায়ে এক নতুন যুগ শুরু হয়, যেখানে ক্রেতাদের ভোগান্তি কমাতে আগে থেকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করার জন্য অনেকে বাবুর্চিদের সাথে চুক্তি করেন। এরপর 'ক্যাটারিং সার্ভিস' ধারণাটি আস্তে আস্তে শহরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
"যখন আমরা পাঁচশো মানুষের রান্না করতাম, আমাদের আয় হতো ৫০০০-১০,০০০ টাকা। আমাদের মজুরি কম ছিল শুধুমাত্র আমরা রান্নার কাজ করতাম বলে। যারা চুক্তি করতো, রান্নার উপকরণ সেই পার্টিই কিনে দিতো", বলেন সালাম।
"কিন্তু ক্যাটারিং ব্যবসায়ে আমরা একশো মানুষের জন্য রান্না করতে ৩০,০০০ টাকা পেতাম এবং নিজেদের আয় হতো ৫০০০ টাকা", সালাম ব্যাখ্যা করলেন।
অর্থাৎ, ক্যাটারিং ব্যবসায়ে কম মানুষের জন্য রান্না করে সেই একই পরিমাণ লাভ থাকে, যা আগে পাঁচশো মানুষের জন্য বাবুর্চি হিসেবে রান্না করে পেতেন। তাই সালামের মতে, ক্যাটারিং ব্যবসা ছিল বেশি লাভজনক।
২০০৫ সালে সালাম নিজে ক্যাটারিং ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেন। মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে 'সালাম ক্যাটারিং সার্ভিস' নামে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন তিনি। অর্ডার বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে, তার ক্যাটারিং ব্যবসাও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১১ সালে তিনি ধানমন্ডিতে ভিক্টোরিয়া কমিউনিটি সেন্টার চালু করেন।
সালাম জানান, এই কমিউনিটি সেন্টার তৈরির জন্য তাকে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার, গলফ গার্ডেন, বসুন্ধরা, সেনা মালঞ্চ, সেনাকুঞ্জ ও পুলিশ কনভেনশন হলসহ নগরীর দশটি প্রধান কমিউনিটি সেন্টারে তার ক্যাটারিং সার্ভিসের নাম রয়েছে।
বাসমতি কাচ্চি বিরিয়ানির আগমন
কাচ্চি বিরিয়ানির প্রতি বাংলাদেশি ভোজনরসিকদের ভালোবাসার কথা কে না জানে! যুগ যুগ ধরে এই খাবারটির প্রতি রয়েছে আমাদের বিশেষ আকর্ষণ। কিন্তু সেসব কাচ্চি তৈরি হতো পোলাওয়ের চাল দিয়ে। বাসমতি কাচ্চি বিরিয়ানি বর্তমানে যেকোনো অনুষ্ঠানের সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম।
সালাম হিসাব করে জানালেন, বর্তমানে শতকরা আশি ভাগ মানুষ বাসমতি কাচ্চি অর্ডার করেন; অন্যদিকে বাকি বিশ ভাগ এখনো পোলাওয়ের চালের কাচ্চিই অর্ডার করেন।
সালাম দাবি করেন, তিনিই প্রথম বাবুর্চি হিসেবে ১৯৯৩ সালের দিকে বাংলাদেশে বাসমতি কাচ্চি বিরিয়ানি প্রবর্তন করেছেন। এর আগে শুধুমাত্র চিনিগুড়া চাল দিয়ে কাচ্চি রান্না করতেন সবাই।
কিন্তু এই নতুন ধারণাটি কিভাবে এলো? ১৯৯৩ সালের এক সকালে, কিছু জিনিসপত্র কিনতে মোহাম্মদপুরের কামাল স্টোরে যান সালাম মিয়া। সেখানে গিয়ে দেখলেন, দোকানি এক বস্তা বাসমতি চাল কম দামে বিক্রি করার জন্য রেখে দিয়েছে।
যেহেতু কুয়েতে তিনি বাসমতি চালের কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করতেন, তাই সেই কাচ্চির স্বাদ ও মান তার জানা ছিল। তাই দোকান থেকে ৫ কেজি বাসমতি চাল কিনে বাড়ি ফেরেন সালাম এবং সেই চালের কাচ্চি রান্না করেন।
"সেদিনের রান্নাটা ছিল সত্যিই অপূর্ব ও সুস্বাদু। এরপর আমার মনে হলো, আমার ক্রেতাদের জন্য বাসমতি কাচ্চি রান্না করা উচিত। তাই আমি দোকানদারকে বললাম, আরও বেশি পরিমাণে এই চাল আনতে", বললেন সালাম মিয়া।
তবে বাসমতি কাচ্চিকে ক্রেতাদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলতেও তার কিছুটা সময় লেগেছে। সালাম তার ক্যাটারিং এর ক্রেতাদের বুঝানোর চেষ্টা করেন, এই চালের কাচ্চি কতটা মজাদার।
"আমার কিছু নিয়মিত ক্রেতা ছিল, যারা চোখ বন্ধ করে আমার রান্নার উপর ভরসা করতো। যখন তারা বাসমতি কাচ্চির জন্য অন্যদের কাছ থেকে প্রশংসা পেল, তখন আমাকে ধন্যবাদ জানালো। তারপর আস্তে আস্তে বাকি ক্রেতারাও এই আইটেম অর্ডার দিতে শুরু করলো", বললেন সালাম।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করলেন, যারা পোলাও চালের কাচ্চি খেতো, তারা অনেকে সেটিই অর্ডার করতেন। কারণ, তাদের মতে, দেশি পোলাও চাল বাসমতি চালের তুলনায় নরম এবং অন্য রকম একটা ফ্লেভার আছে, যা এটিকে বেশি সুস্বাদু করে তোলে।
সালাম বলেন, "আরও অনেক বাবুর্চিই এখন বাসমতি কাচ্চি রান্না করে। কিন্তু যেভাবে তারা এখন রান্না করে, তা কখনোই আমার রান্নার মতো হবে না। কারণ আমি এই রান্নাটা বিদেশ থেকে শিখে এসেছি।"
মহামারিকালীন ক্ষতি
কোভিড-১৯ মহামারির সময়টায় ক্যাটারিং এবং কমিউনিটি সেন্টার সম্পর্কিত ব্যবসা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আঠারো মাস কিংবা তারও বেশি সময় ধরে এই সার্ভিস বন্ধ ছিল। তবে লকডাউন তুলে নেওয়ার পর আবারও এই ব্যবসা সচল হয়েছে।
মহামারির আগে সালাম প্রতি মাসে চল্লিশটিরও বেশি অনুষ্ঠানে খাবার সরবরাহ করতেন। ক্যাটারিং সার্ভিস ও কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবসা মিলিয়ে তখন তার মাসিক আয় ছিল প্রায় এক কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে তার মাসিক আয় বিশ লাখ টাকা।
"মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এখন আর বড় আয়োজন করে না, কারণ তাদের কাছে ওরকম টাকা নেই। শুধুমাত্র অনেক ধনীরাই এখন বড় অনুষ্ঠান করে", বললেন সালাম।
তবে সালাম বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের হিসাবে তার ক্যাটারিং ব্যবসা এখনো বেশ ভালো চলছে। শহরের ভেতরে একশোরও বেশি কমিউনিটি সেন্টার তিনশোর বেশি ক্যাটারিং সার্ভিস নিয়ে কাজ চালায়।
বর্তমানে শহরের বনানি, উত্তরা, পান্থপথ ও মোহাম্মদপুরে সালামের চারটি রেস্টুরেন্ট আছে।
বাংলাদেশের মতো দেশে একজন বাবুর্চি হয়ে সম্পদশালী হওয়া কি সহজ? এমন প্রশ্নে না-সূচক উত্তরই দিলেন সালাম।
তিনি বলেন, "ঢাকা শহরেই এমন অনেক সিনিয়র বাবুর্চি আছেন, যারা টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছেন। এমনকি অনেকে টাকা উপার্জনের জন্য রিকশাও চালান। তারা সবাই আমার মত সৌভাগ্যবান ছিলেন না। কম মজুরির কারণে অনেকেই কোনোরকমে এই পেশায় টিকে আছেন এখনো।"