ঢাকার বাসিন্দারা কি বিরিয়ানি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে?
বলুন তো ঢাকার বাসিন্দাদের প্রিয় খাবার কী? শুরুতেই নিশ্চয়ই মাথায় এসেছে বিরিয়ানির নাম! আসবে না-ই বা কেন! এই শহরের অলিগলিতে ১০ মিনিট হাঁটলে অন্তত তিনটি বিরিয়ানির দোকান তো চোখে পড়বেই। সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত সেসব দোকানের বিরিয়ানির সুবাসের টানে ছোটেন সকল শ্রেণি পেশার মানুষ। পছন্দ অনুযায়ী আয়োজন করে খাওয়া ছাড়াও খিদের সময় সহজলভ্য খাবার হিসেবে রাজধানীতে বিরিয়ানির জুড়ি নেই। তাই পোলাও-মাংসের মিশ্রণে তৈরি এই খাবারের প্রতি বাঙালির আবেগটাও অন্যরকম।
সপ্তাহখানেক ধরে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উত্তাল এই বিরিয়ানির সূত্র ধরেই। কাচ্চি বিরিয়ানির জন্য জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ সুলতান'স ডাইনের কাচ্চিতে খাসির বদলে অন্য প্রাণীর মাংস দেওয়ার অভিযোগ তুলে গত ৫ মার্চ ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন এক ভোক্তা। অল্প সময়ের ভেতর ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায় সেই পোস্ট। দেশজুড়ে বিখ্যাত এই চেইন রেস্তোরাঁর কাচ্চির মাংস নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হওয়ায় আশঙ্কা প্রকাশ করেন অসংখ্য সাধারণ ভোক্তা। এমন নামকরা জায়গার খাবার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগতে হলে সাধারণ খাবার হোটেলের খাবারের মান কেমন হতে পারে তা নিয়েও চিন্তিত নেটিজেনরা।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন দুর্মূল্যের এই বাজারে সব ধরনের মাংসের দাম যে হারে বাড়ছে সে হারে রেস্তোরাঁগুলোতে কেন বাড়ছে না বিরিয়ানির দাম। আকর্ষণীয় মূল্যে বিক্রি করা বিরিয়ানিতে কেমন উপকরণ ব্যবহার করা হয় ভেবে আতংকিত হচ্ছেন অনেকেই। বাইরের খাবার, বিশেষ করে হোটেল-রেস্তোরাঁর গরু-খাসি সমৃদ্ধ যেকোনো বিরিয়ানি জাতীয় খাবার বয়কট করার কথাও বলছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক ব্যবহারকারীই। এ পরিস্থিতি সর্বস্তরের ঢাকাবাসীর বিরিয়ানিপ্রীতিতে কেমন প্রভাব ফেলেছে তা-ই জানতে অনুসন্ধান চালিয়েছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
'ঢাকার বাসিন্দারা কি বিরিয়ানি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে?' প্রশ্ন নিয়ে সম্প্রতি ঘুরে দেখা হয়েছে মগবাজার, মালিবাগ, মৌচাক, বেইলি রোড, ধানমন্ডি ও পুরান ঢাকার প্রায় ২৫টিরও বেশি বিরিয়ানির দোকান। সেই অনুসন্ধানের ফলাফল নিয়েই এই প্রতিবেদন।
যা বলছেন সাধারণ বিরিয়ানি বিক্রেতারা
মগবাজার মোড়ে অবস্থিত নান্না বিরিয়ানী-র একটি ও আল্লাহর দান বিরিয়ানী হাউজের দু'টি শাখা। সেখানকার বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাওয়া হয় গত কয়েকদিনে গরু-খাসির বিরিয়ানি বিক্রিতে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না। একইধনের উত্তর পাওয়া যায় তিনটি দোকান থেকেই। ফেসবুকের আলোচনা দেখে ক্রেতাদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করে মাংসের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছেন দোকানগুলো থেকে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তাদের বিরিয়ানি বিক্রিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। আল্লাহর দান বিরিয়ানি হাউজের কর্মচারী শরীফের ভাষ্যে, "মানুষ খাইতে আইসা মাঝেমধ্যে আলাপ করে কীভাবে কাউরে বিশ্বাস করবো! বাইরে খাওয়া বন্ধ কইরা দিব কি না। তবুও আল্লাহর রহমতে আমাদের সব শাখাতেই আগের মতো বেচাকেনা চলতেছে। এলাকার মানুষেরা আমাদের রেগুলার কাস্টমার।"
মৌচাক, মালিবাগ মোড়, বেইলি রোড ও ধানমন্ডির হাজী কাচ্চি বিরিয়ানী এন্ড ক্যাটারিং সার্ভিস, নান্না বিরিয়ানী, কাচ্চি ভোজের মতো দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়েও পাওয়া যায় একই তথ্য। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে আসায় দোকানগুলোতে বিরিয়ানিপ্রেমীদের ভিড়ও লক্ষ্য করা যায়। মৌচাকের নান্না বিরিয়ানিতে কাচ্চি খেতে আসা শিক্ষার্থী রবিউল বলেন, "সুলতানের কাচ্চি নিয়ে পোস্টটা দেখেছি আমি। কিছুই প্রমাণিত না। খাবারে ভেজাল নিয়ে ভয় তো আছেই। তাই বলে তো বিরিয়ানি খাওয়া কমিয়ে দিতে পারব না। ছোটবেলা থেকে ঢাকার বিরিয়ানি খেয়ে বড় হয়েছি। এত সহজে বিরিয়ানির প্রতি ভালোবাসা কমবে না।"
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানির হালচাল
বিরিয়ানিপ্রেমীদের জন্য স্বর্গরাজ্য হলো পুরান ঢাকা। 'পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানি'র নাম করে বিরিয়ানি ব্যবসা চলে পুরো দেশে। হাজী বিরিয়ানী, নান্না বিরিয়ানী, কোলকাতা কাচ্চি ঘর, হানিফ বিরিয়ানী-র মতো নাম করা বিরিয়ানির দোকানগুলোর উৎপত্তিও এখানেই। সাতরওজা, বেচারাম দেউরী, নাজিরা বাজার এলাকা ঘুরে দেখা মেলে সারি সারি ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানির দোকানের। যেগুলোর কোনোটি বিখ্যাত খাসির কাচ্চি, আবার কোনোটি বিখ্যাত গরুর বিরিয়ানির জন্য।
হাজী, নান্না, কোলকাতা, হানিফের মতো দোকানগুলোতে সবসময়ের মতোই ভিড় লেগে থাকতে দেখা যায় গত শনিবারও। ব্যবসায়ীরাও জানান তাদের বিরিয়ানি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন না কোনো কাস্টমার। বেচারাম দেউরীর হাজী নান্না বিরিয়ানী-তে উত্তরা থেকে সপরিবারে কাচ্চি খেতে এসেছিলেন ডা. আরিফ। তিনি বলেন, "ভাইরাল হওয়া ঘটনার ভিত্তিতে অনেকেই নামী-দামী রেস্টুরেন্টের প্রতি বিশ্বাস হারাবেন। কিন্তু আমার মনে হয় না ব্যবসায়ীরা জেনে-বুঝে তার কাস্টমারদের সাথে এত বড় খারাপ কাজ করবে। আমার নিজের কাচ্চি বিরিয়ানির প্রতি আগ্রহ কমেনি এখনো।"
হানিফ বিরিয়ানীর সামনে দেখা হয় শিক্ষার্থী লিখন কাজীর সঙ্গে। তিনি বলেন, "নাজিরা বাজারের মতো জায়গার বিরিয়ানি নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। এই মাত্র বন্ধুদের সাথে বসে হানিফে খেলাম। দেশের বাড়ি গোপালগঞ্জের জন্যও নিয়ে যাচ্ছি ১০টা বিরিয়ানি পার্সেল করে।"
এলাকার কাচ্চি বাড়ি, কাচ্চি প্যারাডাইস, গ্র্যান্ড নবাব, মামুন বিরিয়ানী হাউজ, বোখারী বিরিয়ানী, মতি বিরিয়ানী হাউজ, খুশবু বিরিয়ানী হাউজ, মদিনা বিরিয়ানী হাউজ, হাজী ইমাম বিরিয়ানী এন্ড কাবাব, নান্নু বিরিয়ানী হাউজের মতো বেশ কিছু দোকানে কথা বলেও জানা যায় কাচ্চি বা অন্য কোনো বিরিয়ানির প্রতি গ্রাহকদের ভালোবাসা কমেনি একটুও।
প্রভাব পড়েছে যেখানে
কাচ্চি বিরিয়ানির জন্য জনপ্রিয় আরেক রেস্তোরাঁ কাচ্চি ভাই। সুলতান'স ডাইনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী তারা। মাস দুয়েক আগে খাবারে কাপড়ে ব্যবহারের রঙ দেওয়ার অভিযোগে তাদেরকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। দুপুর একটার দিকে কাচ্চি ভাইয়ের বেইলি রোড শাখায় গিয়ে দেখা যায় রেস্তোরাঁটি প্রায় ফাঁকা। দুই-তিনটি টেবিলে গ্রাহক বসে খাচ্ছেন।
ব্রাঞ্চ ম্যানেজার শাওন বলেন, "সুলতান'স ডাইনের বিরিয়ানি নিয়ে গুজব শুরু হওয়ার পর মানুষ সারাদিনই তাদের নিয়ে ট্রল করছে। কাস্টমাররা ওদেরকে ফোন করে বলছে যে কুকুরের কাচ্চি অর্ডার করতে চায়, এমনকি আমাদের বিভিন্ন ব্রাঞ্চেও ফোন করে বিরক্ত করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট হলে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে যায় অনেক মানুষের কাছে। এই ঘটনায় আমাদের ব্যবসাতেও অনেক প্রভাব পড়েছে। গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে কাচ্চি বিক্রি কমে গেছে প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ।"
দুপুর তিনটার দিকে কাচ্চি ভাইয়ের ধানমন্ডি শাখায় ভিড় ছিল মোটামুটি। সেখানকার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মো. স্বপন খানও জানান কিছুদিন আগের তুলনায় তাদের বিক্রি কমে গিয়েছে অনেকাংশেই।
যে রেস্তোরাঁ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সেই সুলতান'স ডাইনের বেইলি রোড ব্রাঞ্চে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দেখা যায় ১০-১২ জন কাস্টমার। নিজেদের মধ্যেই তারা বলাবলি করছিলেন যে কিছুদিন আগেও এই সময়ে এলে জায়গা পাওয়া যেত না এই ব্রাঞ্চে। দুপুর আড়াইটার দিকে সুলতান'স ডাইনের ধানমন্ডি শাখায় অবশ্য দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। অন্য সময়ের মতো লাইন দিয়ে অপেক্ষারত কাস্টমার না থাকলেও রেস্তোরাঁর দোতলা ছিল মোটামুটি পরিপূর্ণ আর চারতলা ছিল আংশিক পূর্ণ। অনেকেই উৎসাহ নিয়ে করছিলেন ভিডিও।
রেস্তোরাঁটিতে বান্ধবীকে নিয়ে খেতে এসেছিলেন গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস। তার ভাষ্যে, "আমরা প্রথমে ঢুকে আশেপাশে দেখলাম ভিড় কেমন। কাস্টমারদের ভিড় থাকায় নিশ্চিন্তে খেতে বসলাম। আসলে ফেসবুকের সেই দাবির তো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনো পর্যন্ত। আর এই কন্ট্রোভার্সির কারণে আমার মনে হয় এদের খাবারের মানও উন্নত হয়েছে। কিছুদিন আগেও কাচ্চির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ অনেক বেশি পরিমাণেই কাচ্চি সার্ভ করেছে। এরকম কন্ট্রোভার্সি থেকে যদি খাবার মান উন্নত হয় তাহলে তো এমন ঘটনা ঘটাই ভালো!"
ধানমন্ডি শাখার ম্যানেজার জিয়াউর রহমানের দাবি সুলতান'স ডাইন নিয়ে এত আলোচনা হওয়ায় তাদের পরিচিতিও বেড়েছে দেশে-বিদেশে। কাস্টমারও আগের চেয়ে বেড়েছে গত দুইদিনে।
তবে রেস্তোরাঁর বাইরে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত মানুষদের মুখে শোনা যায় ভিন্ন তথ্য। সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ ওঠার পর সুলতান'স ডাইনে বিরিয়ানিপ্রেমীদের আনাগোনা অনেকটাই কমে গেছে বলে জানান তারা। জিগাতলা বাস স্ট্যান্ডে ডিউটিরত ট্রাফিক সার্জেন্ট হানিফ জানান, গত কয়েকদিনে তেমন একটা কাস্টমার দেখা যায়নি রেস্তোরাঁটিতে। আগে দুপুরে খাবারের সময় খাবার ডেলিভারিতে কর্মরত মানুষদের যে ভিড় থাকতো রেস্তোরাঁর সামনে সেটিও নেই এখন।
পড়ন্ত বিকেলে পুরান ঢাকার সাতরওজায় সুলতান'স ডাইনের শাখায় কয়েকটি টেবিলে দেখা যায় বিরিয়ানি খেতে আসা কয়েকজনকে। সেই শাখার ম্যানেজার রাজু আহাম্মেদ জানান এই অভিযোগের ভিত্তিতে আলোচনা-সমালোচনার কারণে ব্যবসায় প্রভাব পড়েছে কিছুটা। তবে রেস্টুরেন্ট খালি থাকছে না।
সাতরওজা এলাকার ব্যবসায়ী খাজা বলেন, "এই কাহিনীর কারণে ঢাকাবাসীর কাচ্চিপ্রেমে কোনো হেরফের হবে বলে আমার মনে হয়না। যাদের নিয়ে অভিযোগ উঠেছে তারাও কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আবার ঘুরে দাঁড়াবে ব্যবসায়। সাধারণ কাস্টমার যাদের মনে একটু আধটু সন্দেহ আছে তারাও কয়েকদিন পরে ভুলে যাবে। বিরিয়ানির প্রতি মানুষের আগ্রহে কোনো পার্থক্য হবে না এতে।"