৫০০ মাইল হেঁটে কপ-২৬ সম্মেলনে পৌঁছানো পরিব্রাজক দলের গল্প
কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রতিনিধিরা যখন গাড়ি, ট্রেন কিংবা বিমান পাকড়াবেন কি না ভাবছেন; ঠিক ওই মুহূর্তে একদল পরিব্রাজক কেবল পায়ে হেঁটেই লন্ডন থেকে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে এসে পৌঁছেছেন।
গ্লাসগোতে চলমান কপ-২৬ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য টানা ৫৫ দিন হেঁটেছেন নারীদের দ্বারা পরিচালিত একটি ফেইথ গ্রুপ 'ক্যামিনো টু কপ-২৬' এর সদস্যরা। গেল সেপ্টেম্বর থেকে যাত্রা শুরু করে গ্লাসগো পর্যন্ত আসতে মোট ৫০০ মাইল পথ হেঁটেছেন তারা!
চলতি সপ্তাহে যেসব পরিব্রাজক দল পায়ে হেঁটে গ্লাসগোতে এসেছে, 'ক্যামিনো টু কপ-২৬' তাদেরই একটি। এদের মধ্যে কেউ কেউ পোল্যান্ড অথবা জার্মানির মতো দূর-দূরান্তের দেশ থেকে এসেছেন। এমনকি সুইডেন থেকে ১০০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়েও এসেছে একটি দল। 'এক্সটিনশন রেবেলিয়ন স্কটল্যান্ড' নামক একটি গোষ্ঠী জানায়, জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক আলোচনা চলাকালীন অহিংস প্রতিবাদ জ্ঞাপন করতে তারা এখানে এসেছে।
কিন্তু এতকিছু থাকতে পায়ে হেঁটে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া কেন? এর জবাব দিয়েছেন ক্যামিনোর সদস্যরা নিজেই। কিন্তু তার আগে এই সাহসী পরিব্রাজকদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
১৮ বছরের তরুণ থেকে ধরে ৭৪ বছরের বৃদ্ধাও আছেন 'ক্যামিনো টু কপ-২৬' দলে। ক্যামিনো এদিকে এক্সটিনশন রেবেলিয়ন দলেরও অংশ। তাদের উদ্দেশ্য জলবায়ু ও পরিবেশ সংকট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
ক্যামিনোর সদস্যদের সফরের সময় কোনো কোনো দিন ৭০ জন মানুষও তাদের সঙ্গী হয়েছেন। বেশির ভাগ দিন তারা রাত কাটিয়েছেন গির্জার মেঝেতে, গ্রামের হলঘরে এবং কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে শুয়ে। ৫৫ দিনের ভ্রমণে এখন পর্যন্ত ১৭,০০০ পাউন্ড চাঁদা তুলেছেন তারা। নিজেদের ব্যয় বহনের পাশাপাশি বাড়তি টাকা তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু সংকট নিরসনে কর্মরত অধিকারকর্মীদের সাহায্যে ব্যয় করবেন।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়ানো, লোকের দানদক্ষিণা বা আতিথেয়তার উপর বেঁচে থাকার পথ বেছে নেওয়া নতুন কিছু নয়। তবে এবার সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। ক্যামিনো টু কপ-২৬ দলটির সঙ্গী হয়েছে একটি বৈদ্যুতিক ভ্যান। সফরকারীদের জন্য চাল-ডালসহ প্রয়োজনীয় নানা রসদ বহন করে এনেছে এটি।
শুনতে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হলেও, দীর্ঘ আট সপ্তাহ পথে পথে কাটানো খুব সহজ ছিলনা ক্যামিনোর সদস্যদের জন্য। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোস্কা পড়া, হাঁটু ব্যথা, গোড়ালির ব্যথাসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগেছেন তারা। চতুর্দশ শতকের গল্প 'ক্যান্টারবেরি টেলস'-এ উলিয়াম সসার লিখেছিলেন তীর্থযাত্রীদের কথা। চলার পথে একে অপরকে আনন্দ দেওয়ার জন্য নানা রকম গল্প বলতেন তারা। গান ও কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে নিজেদের উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করতেন, এমনকি নাচও ছিল বিনোদনের মাধ্যম। তাই আধুনিক সময়ে এসেও সেই ধারা অব্যহত ছিল ক্যামিনো দলের মধ্যে।
সপ্তাহান্তে মাত্র একবার গোসল করার সুযোগ হয়েছিল ক্যামিনোর সদস্যদের। বার্মিংহামের একটি বিদ্যালয়ের পেশাগত উপদেষ্টার চাকরি ছেড়ে জলবায়ু সংকট নিরসনে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ২৬ বছর বয়সী তরুণী স্টেফ অ্যালডারটন। তার ভাষ্যে, "আমার মনে হয় তখন আমার গা থেকে গন্ধ বেরোতে শুরু করেছিল!" ১০ কেজি ওজনের একটি রানস্যাক ব্যাগে এক প্রস্থ পোশাক, কয়েক জোড়া বাড়তি মোজা, স্লিপিংব্যাগ, স্লিপিং ম্যাট, বই, বাদামের প্যাকেট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়েই ঘর ছেড়েছেন স্টেফ।
ক্যামিনো টু কপ-২৬ এর সদস্যদের ধর্মীয় বিশ্বাসে রয়েছে বৈচিত্র্য। পরম খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ও বৌদ্ধ থেকে শুরু করে স্টেফের মতো নাস্তিকেরাও আছেন এখানে। কী উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে একটি ভ্রমণকে 'তীর্থযাত্রা' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু স্টেফ জানান, তিনি ঈশ্বরের জন্য নয়, বরং যুক্তরাজ্যের মানুষ ও প্রাণীজগত সম্পর্কে জানার জন্য এই সফরে যোগ দিয়েছেন।
স্টেফ বলেন, "আমার জেনে কষ্ট হচ্ছে যে প্রচুর পশুপাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সে কারণেই আমি জলবায়ু সংকটের দিকে মনোযোগ দেই এবং হাঁটা শুরু করি। এর মাধ্যমে সহজেই প্রাণিজগতের সাথে সংযোগ তৈরি করা যায়।"
তিনি আরও বলেন, "কোনো কর্মসূচীতে যোগ দেওয়ার জন্য মানুষের সামনে প্রথমে একটি দরজা খুলে দিতে হয়। স্থানীয় ইস্যুর সাথে যদি মূল সমস্যাকে যুক্ত করা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ তা সহজে বুঝতে পারে এবং সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে।"
ক্যামিনোর এই তীর্থযাত্রা আয়োজনে সাহায্য করেছেন সাউথইস্ট ইংল্যান্ডের সুরে কাউন্টির সেন্ট পিটার অ্যান্ড সেন্ট পল'স চার্চের প্রতিনিধি হেলেন বার্নেট। একজন খ্রিস্টান হিসেবে বার্নেট বিশ্বাস করেন, সবচাইতে দুর্বলদের জন্য কাজ করা তার অবশ্য কর্তব্য। বার্নেট নিজেও তীর্থযাত্রার অর্ধেকের বেশি সময় দলটির সঙ্গে ছিলেন। তার মতে, মানুষ যখন প্রকৃতির কাছাকাছি থাকে, তখনই সৃষ্টিকর্তাকে সবচেয়ে বেশি অনুভব করতে পারে। হাঁটাকে তিনি এক ধরনের প্রার্থনা হিসেবেই দেখেন।
বার্নেট মনে করেন একজন ধর্মীয় নেতা হিসেবে তার প্রতিবাদ করা উচিত, "রাজনীতিবিদরা যার যার ক্ষমতা চায়, কিন্তু একজন ধর্মীয় নেতার তেমন কিছু হারানোর নেই। তাই আমি কথা বলতেই পারি।" এর আগেও একটি জলবায়ু বিষয় আন্দোলনে ল্যামবেথ ব্রিজে জড়ো হওয়ায় বার্নেটকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
ক্যামিনোর এই দীর্ঘ সফরের পরিকল্পনা করেছেন মেলানি নাজারেথ। সবচেয়ে দ্রুততম পথ ব্যবহার করেও তাদের ৪৫০ মাইল হাঁটার পরিকল্পনা হয়। কিন্তু যাত্রাপথে আতিথেয়তার প্রয়োজন অনুভব করে কিছু চার্চের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। ফলে সব মিলিয়ে পথটা ৫০০ মাইলে পরিণত হয়।
নাজারেথ জানান, চলতি পথে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে আরও টেকসই জীবন যাপনের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, "গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই ফসল জন্মায় এবং সেগুলো খায়। তারা জানে তাদের খাদ্যের উৎস কি। তারা জানে কিভাবে কোনো বস্তুকে পুনর্ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ কমাতে যে রাজনৈতিক পদক্ষেপ প্রয়োজ়ন, সে প্রসঙ্গ এলে তারা জানায়, রাজনীতিবিদরা তাদের কথায় পাত্তা দেন না। আমাদের যাত্রা শুরুর গোড়া থেকেই বুঝেছি যে জনসাধারণের জানে, তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই।"
এ বছরই ষাটে পা রাখবেন নাজারেথ। এতদিন হাঁটা বলতে তিনি বুঝতেন শুধু বৈকালিক ভ্রমণ কিংবা স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরা। কিন্তু এবার গ্লাসগো পর্যন্ত যাত্রা তার জীবনকে পাল্টে দিয়েছে।
"একদিন সকালে জেগে উঠলাম আর মনে হলো নিজের মধ্যে নতুন শক্তি এসেছে। আমার পক্ষে যদি এই কাজ সম্ভব হয়, তাহলে অন্যরাও পারবে। শুধু প্রথম পদক্ষেপটা নেওয়া প্রয়োজন। এরপরেই তারা পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাবে", বলেন নাজারেথ।
গ্লাসগোতে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে ক্যামিনো ছাড়া অন্যান্য পরিব্রাজক দলের মধ্যে রয়েছে- পোল্যান্ড, সুইডেন ও জার্মানি থেকে আগত সার্বজনীন দল 'মার্চা এ গ্লাসগো', স্কটল্যান্ডের ডানবার থেকে আগত 'দ্য পিলগ্রিমেজ ফর কপ-২৬' এবং সাউথওয়েস্ট ইংল্যান্ড থেকে আগত 'ইয়ং ক্রিস্টিয়ান ক্লাইমেট নেটওয়ার্ক।
'ক্যামিনো টু কপ-২৬' দলটির কাছে হাঁটা মানে শুধুই পথচলা নয়, বরং আরও গভীর কিছু। মূলত হাঁটাপথে সফরের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা, প্রকৃতি, প্রাণিজগত ও মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে চায় তারা। সবশেষে বার্নেট মনে করেন, "আরও অনেক রাজনৈতিক প্রতিনিধি যদি এভাবে হেঁটে কপ-২৬ সম্মেলনে পৌঁছতেন, তাহলে তারা একটি সম্প্রদায় তৈরি করতে পারতেন যারা জলবায়ু সংকট নিরসনে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দিকে এগিয়ে যেত। কারণ তীর্থযাত্রা আমাদেরকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে শেখায়।"
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান