‘নতুন স্বাভাবিকে’ ফিরে আসবে কি হ্যান্ডশেকের চর্চা
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এখনও কাটেনি করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভের প্রভাব। তবু মহামারির কালো ছায়ার পাশ কাটিয়ে আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত দেশগুলো। আইসোলেশন সেরে দীর্ঘদিনের দেখা না হওয়া বন্ধু আর পরিজনদের সাথে মিলিত হতে শুরু করেছে এসব দেশের মানুষেরা।
কিন্তু দেখার পর প্রথম অভিবাদন টা হবে কী করে? মহামারির ফলে যে বন্ধ হয়ে গেছে হ্যান্ডশেক বা করমর্দনের চর্চা!
'নতুন স্বাভাবিকে' কি তবে হারিয়ে যাবে হ্যান্ডশেকের চল!
এ প্রশ্নের আদতে কোন সঠিক উত্তর নেই। এটা সত্যি যে, ১৫ মাস আগের আর পরের পরিস্থিতি অনেক ভিন্ন। এখন মানুষ ভাইরাস সম্পর্কে অনেক জানে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভ্যাকসিনেরও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। তারপরেও অনেকেই এখনো হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে সংস্পর্শের মাধ্যমে সংক্রমণের শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন।
আমরা কেন করমর্দন করি
হ্যান্ডশেক বা করমর্দনের প্রচলন ঠিক কীভাবে শুরু হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়, তবে এ চর্চা প্রায় হাজার বছর ধরে চলে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ শতকে লেখা গ্রিক মহাকাব্য 'ওডিসি' তে হোমার একে অপরকে হাত জড়ো করে অভিবাদন জানানোর কথা উল্লেখ করেছেন।
কারো প্রতি খালি হাত বাড়িয়ে দেয়ার আরেকটি ঐতিহাসিক তত্ত্ব রয়েছে। এর অর্থ হলো, আপনি শান্তির জন্য এসেছেন এবং আপনার কাছে কোন অস্ত্র নেই। করমর্দন কারো প্রতি ওয়াদা রক্ষার্থে বিশ্বাসেরও প্রতীক।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিনয়ের সাথে নিজেকে কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা একটি সাধারণ চর্চা। অন্তত মহামারির আগমনের পূর্বে একে এভাবেই দেখা হত।
এখন যখন আস্তে আস্তে পৃথিবী আবার 'স্বাভাবিকতা'র দিকে ফিরে যাচ্ছে, মানুষের কাছেও হ্যান্ডশেকের আবেদন ফিরছে। তবে করোনাভাইরাসের আগেও জীবাণু নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকের কাছেই করমর্দনের চর্চা পছন্দের ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার অধিবাসী কাইলি উডস (৫৬) বলেন, "আমার মতে আমাদের সামাজিকায়নের জন্য করমর্দন, বিশেষ করে মানুষের সংস্পর্শ অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা যুক্তিযুক্তভাবে এর চর্চা আবারও ফিরিয়ে আনতে পারি, তবে যারা সংক্রমণ নিয়ে উদ্বিগ্ন তাদের প্রতি সম্মান রেখেই আমাদের এগোনো উচিত"।
বলাই বাহুল্য, মহামারি শুরু হতেই মানুষের মাঝে হ্যান্ডশেকের প্রবণতা কমে গেছে। বরং দুনিয়াজোড়া মানুষ মুষ্টি বা কনুই নেড়ে বিকল্প উপায়ে একে অপরকে অভিবাদন জানাচ্ছেন এখন।
কেউ কেউ অবশ্য বাঁধ সেধেছেন সেখানেও।
ডাবলিনের বাবস ফারকাসভস্কির কাছে যেমন মহামারির আগে করমর্দনের প্রতি কোন বিরোধ ছিল না, কিন্তু এখন তিনি কোন রকম সংস্পর্শে না গিয়ে আগন্তকদের নিছক 'হ্যালো' বলে সম্বোধন করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য করছেন। মহামারিকালে প্রথম বার তিনি যখন কনুই ঠেকিয়ে বন্ধুদের সম্বোধন করতে গেলেন, তখন নিজের কাছেই নিজেকে বোকা বোকা লেগেছে তার।
বাবস বলেন, "যতক্ষণ না আমি ওপাশের মানুষটির পরিচয় সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এই মুঠোবন্ধ বা কনুই ঠেকানোর দলে নেই"।
বিজ্ঞান কী বলছে
এক বছর আগে মহামারির শুরুতে হ্যান্ডশেক করতে নিরুৎসাহিত করা হলেও, এখন মানুষ কোভিড-১৯ এর বিস্তারের পেছনে আরও কারণ সম্পর্কে জানে। করোনাভাইরাস প্লাস্টিক এবং স্টেইনলেস স্টিলের উপর তিন দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে, ফলে সারাক্ষণ সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার রাখতে হবে- প্রথম দিকে এভাবেই সবাইকে সতর্ক করতেন আমেরিকার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এখন গবেষণার বরাতে ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বলছে, বাতাসে ভেসে থাকা কণার মাধ্যমেই প্রধানত ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে।
একজন বিশেষজ্ঞের মতে, হ্যান্ডশেকের জন্য এটি একইসাথে ভাল এবং খারাপ সংবাদ।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যাপক ড. উইলিয়াম শ্যাফনার জানান, টিকা নিয়েছেন এমন কারো সাথে হাত মিলাতে তার কোনও দ্বিধা হবে না।
তবে এখানে শরীরী সংস্পর্শটাই উদ্বেগের মুখ্য কারণ নয়।
এর ব্যাখ্যায় ড. উইলিয়াম শ্যাফনার বলেন, "আমি মনে করি হাত মেলাতে যখন একজন ব্যক্তি আরেকজনের খুব নিকটে চলে আসে, ঝুঁকিটা সেখানে"।
করমর্দনের পর দু'জন ব্যক্তি কিছুটা সময় নিজেদের অত্যন্ত কাছাকাছি অবস্থান করে এবং কথোপকথনে লিপ্ত হয়। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়।
বেশি মাত্রায় লোকজন টিকা নিলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে অপরিচিত ব্যক্তিদের হাত মিলিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে আর কোন চাপ থাকবে না বলে মনে করেন শ্যাফনার।
- সূত্র- সিএনএন